ময়মনসিংহ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে পাটগুদাম এলাকার শতকোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমি অবৈধভাবে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রির ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে সরকারি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত জমিটির মালিকানা দাবি করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জালিয়াতির আশ্রয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দলিল ও রেকর্ড অনুযায়ী, ময়মনসিংহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত এই জমিটি ছিল রেবতী মোহন দাস নামের এক ব্যক্তির। ১৯৬৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দলিল নং ১০৭ অনুযায়ী জমিটি হস্তান্তর করা হয় আদমজী জুট মিলস লিমিটেডের নামে। এরপর ১৯৬৪ সালে নামজারি সম্পন্ন এবং সরকারিভাবে খারিজ খতিয়ান প্রস্তুত হয়।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) জানায়, জমির দলিলটি পাকিস্তানের করাচি জেলার রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষিত আছে এবং এটি বৈধভাবে সরকারি মালিকানায় অন্তর্ভুক্ত। মিল বন্ধ হওয়ার পর জমিটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও বিআরএস জরিপে এটিকে সরকারি খতিয়ান নং ১/১-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রায় ৬ দশক পর ২০২২ সালে রেবতী মোহন দাসের ছেলে পরিচয়ে রবীন্দ্র মোহন দাস জমির মালিকানা দাবি করে জেলা প্রশাসক ও বিজেএমসির বিরুদ্ধে মামলা (নং ৫১৪/২২) করেন। আদালত চলতি বছরের ৮ মে মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু আদালতের রায় হওয়ার আগেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্র মোহন দাস মিরাশ উদ্দিন সুমনকে আমমোক্তারনামা প্রদান করেন। পরে সেই আমমোক্তারনামার ভিত্তিতে মামলাটি নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মামলায় পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে এ বছরের ২৮ আগস্ট।
এই মামলার শুনানি চলাকালীন চলতি বছরের ৬ জুন মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও জমিটির ৮৪ শতক মাত্র ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় দাম নির্ধারণ করে বিক্রির দলিল সম্পাদন করা হয়। দলিলে দাতা হিসেবে রবীন্দ্র মোহন দাসের নাম ব্যবহার করা হয় এবং তার পক্ষে স্বাক্ষর করেন সিনিয়র সহকারী জজ পবন চন্দ্র বর্মণ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জমিটির প্রকৃত বাজারমূল্য ১০০ কোটির বেশি। অথচ আদালতের আদেশ দেখিয়ে অস্বাভাবিক কম দামে জমি রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন, আদালতপাড়া এবং সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় ভূমি সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকারি খতিয়ানে নাম থাকা জমি কীভাবে ব্যক্তি মালিকানায় রেজিস্ট্রি হয়? এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
পাটগুদাম এলাকার ব্যবসায়ী মজিবর রহমান জানান, জমি দেখতে কয়দিন পরপর এখানে লোকজন আসতো। তারা দাঁড়িয়ে কথা বলতো। দুই-তিন মাস আগে কয়েকজন লোক এসে জমি মাপজোখ করে গেছে। তারা নাকি সরকারি জমি কিনছে। এখন শুনতাছি সরকারি জমি আদালতের মাধ্যমে ভুয়া দলিল করে নিয়া গেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মহানগর সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, সরকারি খতিয়ানভুক্ত জমি সাড়ে ৫ লাখ টাকায় হাতবদলের বিষয়টি প্রশাসন, আদালত ও ভূমি অফিসের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কম দামে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যেকোনো মূল্যে হক এই সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। শতকোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে দুদকসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে এদেরকে চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির আওতায় আনলে, পরবর্তীতে এই ধরনের অন্যায় আর হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা জজ আদালতের এক বেঞ্চ সহকারী বলেন, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট আইনের ফাঁকে এভাবে রাষ্ট্রীয় জমি বেহাত করছে। উত্তরাধিকারীর নামে মামলা, তারপর আমমোক্তারনামা, এরপর আদালতের আদেশের নামে রেজিস্ট্রি এ সবই সাজানো।
সিনিয়র আইনজীবী শাহজাহান কবির সাজু বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষায় অবিলম্বে দলিল বাতিল ও দোষীদের শাস্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আজিম উদ্দিন জানান, প্রাথমিকভাবে গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত চলছে। প্রমাণিত হলে দলিল বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার জাহিদ হাসান বলেন, আমরা আদালতের আদেশ পেয়েছি, যেখানে সিনিয়র সহকারী জজ পবন চন্দ্র বর্মণ জমি রেজিস্ট্রির নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের আদেশ থাকলে মৌজা রেট অনুসরণের বাধ্যবাধকতা থাকে না।
তিনি বলেন, এটি যেহেতু আদালতের আদেশ ছিল, তাই আমার কিছু করার ছিল না। শতকোটি টাকা মূল্যের জমি কীভাবে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা মূল্য দেখানো হলো এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে জমি রেজিস্ট্রি হলে মৌজা রেট অনুসনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’
অন্যদিকে মামলার আমমোক্তার মিরাশ উদ্দিন সুমন ফোনে ব্যস্ততার অজুহাতে মন্তব্য না করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
জুট মিলস করপোরেশনের মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা মো. নাসিমুল ইসলাম বলেন, জমিটি আমাদের করপোরেশনের। জালিয়াতির বিষয়টি আমরা জানি। দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা আলোচনা করছি।
জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি তদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পেলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।