জানুয়ারির এক ঠান্ডা সকাল। সূর্য তখনো আলোর আঁচড় ফেলতে পারেনি। কুয়াশার চাদরে ঢাকা তিতুমীর কলেজের প্রাঙ্গণ যেন এক টুকরো গ্রামবাংলার মেলার চিত্র। শহরের ব্যস্ততার বাইরে এমন এক পিঠাপুলি মেলার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যেন মনের ভেতরে গ্রামবাংলার সরলতা ও সৌন্দর্যের শিহরণ জাগায়।
গ্রামবাংলার মেলা বললেই মনে পড়ে পিঠার কথা। এই মেলায় শোভা পাচ্ছিল চিতই, পাটিসাপটা, ডিমের পিঠা, গোলাপ পিঠা, দুধপিঠার মতো দেশজ সুস্বাদু পিঠা। প্রত্যেকটি পিঠা আলাদা গল্প বলে।
কারো শৈশবের দুপুরবেলা মায়ের হাতের পাটিসাপটা, কারোবা শীতের রাতে গরম চিতইয়ের সঙ্গী খেজুরের গুড়। এক বৃদ্ধ দর্শনার্থীর কথায়, মনে পড়ে শৈশবে মায়ের সঙ্গে এমন মেলায় আসতাম। সেই পিঠার স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে।
যাদের জীবনে গ্রামবাংলার অভিজ্ঞতা নেই, তারাও যেন প্রথমবার এই ঐতিহ্যের স্বাদ চেখে দেখছেন। একটি মেয়ের উচ্ছ্বাস, এত বাহারি নকশা করা সুন্দর গোলাপ পিঠা আগে কখনো দেখিনি। খেতে যেমন মজার, তেমনই দেখতে।
শুধু পিঠার স্বাদে নয়, মেলার সৌন্দর্য তার মানুষের কোলাহলে। একদিকে সাজানো গেইট, অন্যদিকে গ্রামীণ ঐতিহ্যের আবহে সাজানো পিঠার স্টল। গ্রামবাংলার আদলে কারুকার্য যেন অতীতকে জীবন্ত করে তুলেছে।
এক বৃদ্ধা তার নাতিকে নিয়ে হাঁটছেন। `এগুলোই তো আমার ছোটবেলার গল্প', বলছিলেন তিনি। তার চোখে স্মৃতির জল, মুখে হাসি। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। যেন শেকড়ের সঙ্গে সংযোগের অনুভূতি।
- আরও পড়ুন
- চট্টগ্রামের হালিশহর সমুদ্রসৈকত নাকি ‘বাংলার সুইজারল্যান্ড’
- ইতালির বিস্ময়কর গ্রাম রিওম্যাগিওর
গ্রামবাংলার শীত মানেই খেজুরের গুড়ের পিঠা। মেলার এক কোণে একটি বিক্রি হচ্ছিল সেই ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়ের পিঠা। শীতের সকালে সেই গরম পিঠা যেন সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে।
মেলার পাশাপাশি শহীদ বরকত মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় নাটক ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। গল্পটি ব্রিটিশ আমলের ময়মনসিংহ অঞ্চলের জলসুখা গ্রামের পটভূমিতে রচিত, যেখানে ঘেটুগান নামে একটি সঙ্গীতধারার উদ্ভব হয়।
এই সঙ্গীতধারায় মেয়েদের পোশাক পরা কিশোররা নাচ-গান করত, যাদেরকে ঘেটু বলা হতো। নাটকের পাশাপাশি পুঁথিপাঠ। গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলতে পুঁথি পাঠপাঠ বিশেষ ভূমিকা রাখে উৎসবে। সাথে ছিল মনমাতানো নাচগান।
এই মেলা শুধু উৎসব নয়, বরং একটি দিনের জন্য হলেও গ্রামবাংলার শেকড়কে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ। মাটির ঘ্রাণ, পিঠার স্বাদ, নাটক, পুঁথিপাঠ আর মেলার কারুকাজ সব মিলে যেন শহরের ব্যস্ত জীবনের বাইরে এক গ্রামীনরাজ্য।
মেলা শেষ হলেও তিতুমীর কলেজের প্রাঙ্গণে রয়ে গেল সেই দিনের আবেগ। পিঠার গন্ধ, মানুষের হাসি আর গ্রামবাংলার মাটির ছোঁয়া সবার মনে স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকবে।
জেএমএস/এএসএম