পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ক্যাথলিক পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটির পড়ালেখার যেমন সুনাম রয়েছে, তেমনই পরিবেশও শান্ত। শিক্ষার্থীদের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার ব্যাপারে বরাবরই কঠোর কর্তৃপক্ষ। শিক্ষক-কর্মচারীরাও জড়ান না রাজনীতি বা বাইরের কোনো কর্মকাণ্ডে। এক কথায় ঝঞ্ঝাটমুক্ত শিক্ষাঙ্গন এটি।
এমন ‘সুশৃঙ্খল ও শান্ত’ পরিবেশের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ২৪ নভেম্বর অতর্কিত হামলা চালায় শিক্ষার্থী নামধারী ৩০-৩৫ জন তরুণ-যুবক। হঠাৎ, নিরাপত্তা প্রহরীদের পিটিয়ে আহত করে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। ক্যান্টিনে ভাঙচুর চালিয়ে টাকা লুট করে হামলাকারীরা। এরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষক-অভিভাবকরা বলছেন, ঘটনার দিন স্কুল ছুটির পর হামলা হয়েছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকিতে পড়েনি। কর্মচারীরা অনেকে মার খেয়েছেন। তারপরও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা কাটছেই না। তারা সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয়-শঙ্কায় পড়েছেন।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফটক বন্ধ। ফটকের সামনের দেয়ালে পাশাপাশি দুটি বিজ্ঞপ্তি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর একটিতে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেন্ট গ্রেগরি বন্ধ ঘোষণা’র নোটিশ। অন্যটিতে ‘প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তির লটারি স্থগিত’র নোটিশ।
- আরও পড়ুন
- সেন্ট গ্রেগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ বন্ধ ঘোষণা
- শিক্ষার্থীদের ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা, ‘সতর্ক’ থেকেই দায় সারলো পুলিশ
প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের কাচের জানালা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাচের টুকরো ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন কর্মচারীরা। তবে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের দেখা যায়নি।
স্কুলে থাকা অফিস সহকারী শিপন বাগচি বর্ণনা দেন কীভাবে হামলা-ভাঙচুর হলো। তার ভাষ্যমতে, ‘দুপুর ২টায় স্কুল ছুটি হয়ে যায়। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে হঠাৎ নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে ৩০-৩৫ জন যুবক স্কুলে ঢুকে পড়েন। তাদের বাধা দিতে গেলে নিরাপত্তাকর্মী নাজমুল হক ও সুমন গোমেজকে ব্যাপক মারধর করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তারা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’
হামলা চালিয়েছে কারা?
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর ঘটনা ঘিরে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল ঘেরাও করে বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে কলেজগুলোর কথিত একটি মোর্চার ডাকে ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা করে ২৪ নভেম্বর হামলা চালানো হয়।
সেই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি ঝঞ্ঝাটমুক্ত সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজও। মূলত মোল্লা কলেজসহ বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাছ-বিচার না করেই সেদিন সেন্ট গ্রেগরিতে হামলা চালিয়েছিল। তবে হামলার পর তারা স্কুলের ফটকসহ বিভিন্ন স্থানে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরাও খুলে নিয়ে যায়। ফলে ঠিক কারা হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না সেন্ট গ্রেগরির শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেন্ট গ্রেগরির অফিস সহকারী শিপন বাগচি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারা চোখের পলকে ভাঙচুর চালিয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। যারা বাধা দিয়েছেন, তাদের মারধর করেছে। এরা কারা তা তো আমরা জানিও না, চিনিও না।’
ভর্তির লটারি ও পরীক্ষা স্থগিত
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। স্কুল বন্ধ ঘোষণা করায় পরীক্ষাগুলোও স্থগিত রয়েছে। এছাড়া দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল। তাদের পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে।
অন্যদিকে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তিতে লটারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২৫ ও ২৬ নভেম্বর। একদিন আগে স্কুলে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় লটারির পরিবেশ নেই। ফলে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই ও ভর্তি কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।
ভয়-উৎকণ্ঠা কাটছেই না
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে সীমান্ত রায়। হামলা-ভাঙচুর দূরে থাক, সে কখনো স্কুলে বাগবিতণ্ডাও দেখেনি। সবসময় কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়েছে।
স্কুলের খুব কাছেই পরিবারের সঙ্গে থাকে সীমান্ত। হামলার পর সে মায়ের সঙ্গে স্কুলের সামনে এসেছিল। হঠাৎ স্কুলে এমন ভাঙচুর দেখে সীমান্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তার মা সোহা রানী।
সোহা রানী জাগো নিউজকে বলেন, এ স্কুলে কোনো ঝামেলা নেই। পড়াশোনার পরিবেশ ভালো। এজন্য একটি প্রি-ক্যাডেট থেকে ছেলেকে সেন্ট গ্রেগরিতে ভর্তি করিয়েছিলাম। এ স্কুলের কেউ কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনো ঝামেলায় জড়ায় না। ছাত্ররা তো এসবে যায়ই না, শিক্ষক-কর্মচারীদেরও নিয়ম মানতে হয়। সেখানে এমন হামলা মেনে নিতে পারছি না।
তিনি বলেন, ‘ছেলেটা ওর স্কুলে ভাঙচুর দেখেছে। এখন স্কুলে যেতে ভয় করছে ওর। আমাদেরও তো ভয় ভয় লাগছে। কখন না জানি আবার কী হয়!’
জানতে চাইলে সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ ব্রাদার লিওনার্দ চন্দন রোজারিও জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে অবগত করেছি। যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো সংস্কার শুরু করা হবে। স্কুল খুলতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। নোটিশ দিয়ে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।’
সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘটনার পর পুলিশের একটি টিম পাঠানো হয়েছিল। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসেছে। জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস