মো. আমিনুল ইসলাম। প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাবুপুর বেলায়েত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সঙ্গে। আর অল্প কয়দিন পরই যাবেন অবসরে। গেলো ৫ আগস্টের আগে তার ফোনটি হাতে নিয়েছিল ৭ বছরের নাতি। নাতি ভুলক্রমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একটি ছবি পাঠিয়ে দেন শিক্ষকদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনশট নিয়ে রেখে দেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ। এরপর ছবিটি মুছে ফেলা হলেও রক্ষা হয়নি ওই বৃদ্ধ শিক্ষকের। দাবি করা হয় ২০ হাজার টাকা। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে দেওয়া হয় শোকজ নোটিশ।
শুধু আমিনুল ইসলাম নয়, এভাবে শিক্ষকদের কাছে নিয়মিত ঘুস বাণিজ্য করে আসছেন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ। এমনকি উন্নয়নের স্লিপ, শান্তি বিনোদন, ডেপুটেশন, মাতৃত্বকালীন ছুটি পাস, নতুন শিক্ষক নিয়োগে অর্থ বাণিজ্য তার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আবার কেউ টাকা দিতে না পারলে আদায় করা হয় মাছ-মাংস এমনকি বাড়ির বাজার।
আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমার ৭ বছরের নাতি ভুল করে শিক্ষকদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একটি ছবি পাঠিয়ে দেয়। এতেই বাধে বিপত্তি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনশট নিয়ে রেখে দেন। এরপর তিনি চাকরি থাকবে না বলে হুমকি দেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু তিনি কোনো কথা না শুনে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে তার শোবার রুমে গিয়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। তারপরও আমাকে শোকজ করেছেন। শুধু আমি না, উপজেলার সব শিক্ষক তার কাছে জিম্মি।
উপজেলার দিয়ার পশ্চিম জাহাঙ্গীর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল-ইমরান বলেন, সম্প্রতি উপজেলায় নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৭৯ জনকে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছে ২০০০ হাজার টাকা। এছাড়া বদলি বাণিজ্য, স্কুল উন্নয়নের স্লিপ, শান্তি বিনোদন, ডেপুটেশন, বেতনবিবরণী সিট তৈরি, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন বাবদ ফি আদায় ও অসুস্থ শিক্ষকদের ছুটি দিয়ে পুরো মাসের বেতনের নামে অর্ধেক টাকা আদায় করেন পরিমল কুমার ঘোষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারী শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য পরিমল কুমার ঘোষকে অন্তত তিন হাজার টাকা না দিলে ছুটি পাওয়া যায় না। এমনকি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন তিনি। এমন যদি হয়, আমরা কোথায় যাবো। এটি সত্যি দুঃখজনক।
উপজেলার চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাকিরুল ওহিদ বলেন, ২০২৩ সালে নিয়োগ পেয়েছি। আমার সঙ্গে মোট ১৩৫ জন নিয়োগ পেয়েছিলেন। সেসময় সার্ভিস বুক খোলার নাম করে সবার কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে নিয়েছেন। সেসময় থেকেই দেখছি উপজেলা শিক্ষা অফিসে গেলেই টাকা লাগে। অফিসের যেকোনো কাজ টাকা ছাড়া হয় না। উপজেলার সব শিক্ষক এই কর্মকতার কাছে জিম্মি। এই ঘুস বাণিজ্য করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন এই কর্মকর্তা।
ত্রিমহোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাহিরুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালে নিয়োগ পেয়েছি। তখন আমার কাছে ২ হাজার টাকা নিয়েছেন সার্ভিস বুক খুলবেন বলে। পরে জানতে পারি শুধু আমার কাছে নয়, আমার সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত ৮৬ জনের কাছে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। এই টাকা ফেরত দিতেও চেয়েছিলেন পরিমল কুমার ঘোষ। আমরা এই টাকার জন্য কয়েকদিন অফিসেও গিয়েছি। কিন্তু এখনো টাকা পাইনি।
শাহাপুর ইউনিয়নের রাঘববাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাকসুদুর রহমান জুয়েল বলেন, আমরা যে টাকা বেতন পাই, সেই টাকায় ভাগ বসান উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। অফিসে গেলেই টাকা লাগবে। উপজেলায় প্রায় ১৪০০ শিক্ষক এখন তার কাছে অসহায়। আমাদের কিছুই করার নেই। কিছু বললেই শোকজ হতে হয়। এমনকি এই কর্মকর্তার বাড়ির বাজারও শিক্ষকদের করে দিতে হয়।
শ্যামপুর ইউনিয়নের গীতিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের টাকায় ভাগ বসান এই কর্মকর্তা। আমার বিদ্যালয়ের স্লিপ ফান্ডের টাকা থেকে ঘুস চাচ্ছিলেন পরিমল কুমার ঘোষ। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া হয়। এমনকি বলতে থাকেন এই টাকা কি তোমার বাপের। তার কাছে আমরা মানুষ না। এমনটাই মনে হয়। এজন্য খুব জরুরি কাজ না থাকলে উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাই না।
শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ বলেন, এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি কারো কাছে কোনো টাকা নিয়েছি বলে আমার মনে হয় না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জেছের আলী জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়গুলো আমার নজরে নেই। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা হবে।
এফএ/এএসএম