শিক্ষার্থীরা আমাদের অবস্থান-কর্মকাণ্ড পছন্দ করায় বিপুল ভোটে জয়

1 day ago 4

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) মোট ২৮টি পদের ২৩টিতেই নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের এ জয় ইতিহাসগড়া।

ডাকসু নির্বাচন ও শিবিরের জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসুর প্রভাবসহ নানান বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রায়হান আহমেদ

যারা আমাদের বুলিং করেছে, ট্যাগ দিয়েছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু বলিনি। বরং, ভালো আচরণ দিয়ে বার্তা দিয়েছি। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীরা বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণে আমাদের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড পছন্দ করেছে। ফলে বিপুল ব্যবধানে জয় এসেছে

জাগো নিউজ: ডাকসু নির্বাচনে আপনারা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এই ফলাফলকে কীভাবে দেখছেন?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: আমরা কৃতজ্ঞ, কারণ দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী আমলে আমাদের ওপর যে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। শিক্ষার্থীরা আমাদের গ্রহণ করেছে। নিঃসন্দেহে তাদের আমাদের প্রতি যে আস্থা, সেই আস্থার জায়গা থেকেই তারা ভোট দিয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞ, বিশেষ করে যারা জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, আহত হয়েছেন—তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই ডাকসুর এই যাত্রা সম্ভব হয়েছে। ফলে একটা নতুন বাংলাদেশে একটু সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে।

এই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় উদাহরণ তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীরা নতুন অনেক কিছু অ্যাডাপ্ট করেছে, বিশ্লেষণ করেছে এবং তাদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে ভোট দিয়েছে। আমরা ছাত্রদের সঙ্গে মিশেছি, আমাদের কথাগুলো উজাড় করে দিয়েছি। যারা আমাদের বুলিং করেছে, ট্যাগ দিয়েছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু বলিনি। বরং, ভালো আচরণ দিয়ে বার্তা দিয়েছি। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীরা বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণে আমাদের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড পছন্দ করেছে। ফলে বিপুল ব্যবধানে জয় এসেছে।

আমরা ডাকসুকে ছাত্রশিবিরের ফ্রেমে আবদ্ধ করতে চাই না। এটা শিক্ষার্থীদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম। আমরা আহ্বান জানিয়েছি—শুধু শিবির নয়, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদেরও আমরা আমাদের প্যানেলে রেখেছি

জাগো নিউজ: নির্বাচনের শুরু থেকেই আপনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ ছিল। বিষয়টি কীভাবে আপনারা সামলেছেন?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন বা ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আমরা বারবার ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর ও প্রক্টোরিয়াল বডির সঙ্গে বৈঠক করেছি। ১৮টি ছাত্রসংগঠন একসঙ্গে বসতো, যেখানে তারা তিন ঘণ্টার মধ্যে আড়াই ঘণ্টা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলতো। আমাদের ৪-৫ মিনিট কথা বলার সুযোগ দিতো। আমরা বলেছি—এই মিথ্যাচার এখন আর কেউ গ্রহণ করবে না। আমরা কাজের মাধ্যমে, সততার মাধ্যমে ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

আওয়ামী আমলে যারা আমাদের সহযোদ্ধা ছিল, আমরা খালেদা জিয়ার ডাকে বহুবার আন্দোলন করেছি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা একই সঙ্গে লড়েছি। অথচ এখন তারা আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, বসতে চেয়েছি। বলেছি—নতুন মেরুকরণে নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে। কিন্তু তারা রেসপন্স করেনি। আমরা কাজ করে গেছি। সেখানেই এই ফলাফল আমাদের অবস্থানের ন্যায্যতা প্রমাণ করেছে। সামনে যারা ট্যাগিং করে রাজনীতি চালিয়ে যেতে চায়, তারা যদি ডাকসুর মধ্য দিয়েও সংশোধন না হয় তাহলে তাদের জন্য চূড়ান্ত পরিণতি অপেক্ষা করছে।

যেসব রাজনৈতিক দল ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত—এই নির্বাচন তাদের জন্য একটি বড় মেসেজ যে, দেশের স্বার্থে রাজনীতি করতে হবে, বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়

জাগো নিউজ: ডাকসু নির্বাচনে রাত ১২টার পর গুঞ্জন উঠেছিল বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে, তারা শীর্ষ তিন পদের যে কোনো একটি চাইছে। শেষ পর্যন্ত শিবির একক সাফল্য পেয়েছে। এ গুঞ্জনের বিষয়ে বলুন?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: নির্বাচনে কোন প্যানেলে কারা থাকবে, সেটা ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটি ঠিক করে। জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো প্রভাব আমাদের ওপর নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। বিশেষ করে আমার সঙ্গে না। আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গেও হয়নি যতদূর জানি। এটা ছিল গুজব।

হয়তো তারা চেষ্টা করেছিল কোনো মাধ্যমে, হয়তো সেটা আমাদের মধ্যে পৌঁছায়নি। আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ভোট ম্যানিপুলেট করা অসম্ভব। শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে, আমরা সেই আস্থার আমানত রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

জাগো নিউজ: জাতীয় নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার কি ডাকসুতে ক্ষমতার প্রভাব তৈরি করবে? ছাত্রশিবিরের প্যানেল কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: আমরা ডাকসুকে ছাত্রশিবিরের ফ্রেমে আবদ্ধ করতে চাই না। এটা শিক্ষার্থীদের একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম। আমরা আহ্বান জানিয়েছি—শুধু শিবির নয়, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদেরও আমরা আমাদের প্যানেলে রেখেছি। এমন প্রার্থী ছিল যারা আগে বিভিন্ন সময়ে শিবিরের সমালোচনা করেছিল। আমরা প্যানেলে বৈচিত্র্য রেখেছি। তাই শুধু শিবির নয়, শিক্ষার্থীরা কোনো প্রভাব মেনে নেবে না।

আর ডাকসু পরিচালিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। আর সেটা হবে ছাত্রদের কল্যাণে। জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনে ডাকসু কথা বলবে, কিন্তু কোন দল ক্ষমতায় এলো, কোন দল প্রভাব ফেললো সেটা দেখে ডাকসুর নেতারা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। যে কোনো দল সরকারে থাকুক না কেন, ডাকসু স্বাধীনভাবেই কাজ করবে। আগেও যেসব সরকার ডাকসুতে প্রভাব ফেলতে চেয়েছে, তাদের ব্যাকফায়ার হয়েছে। তাই ডাকসু তার স্ট্যান্ড বজায় রাখবেই।

জাগো নিউজ: ডাকসুতে এই জয় শিবির জাতীয় রাজনীতিতে কীভাবে কাজে লাগাবে?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: ডাকসুর ইতিহাস থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। আমার কাছে এই নির্বাচনের দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের কারণে একটি ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারেনি। এটা ২০১৯ সালের নির্বাচনের মতো নয়—যেখানে মারধর, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এবার শিক্ষার্থীরা আমাদের আচরণ, কর্মপদ্ধতি ও কমিটমেন্ট দেখে ভোট দিয়েছে।

রাজনীতির একটি নতুন বন্দোবস্ত তৈরি হয়েছে। এখনকার নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। জাতীয় রাজনীতিতে এটা একটা বড় শিক্ষা ও বার্তা। যেসব রাজনৈতিক দল ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত—এই নির্বাচন তাদের জন্য একটি বড় মেসেজ যে, দেশের স্বার্থে রাজনীতি করতে হবে, বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়।

জাগো নিউজ: এই জয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কতটা কেমন প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: আমরা জাকসুতে, রাকসুতে, চাকসুতে প্যানেল দিয়েছি। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে আছি, কথা বলেছি। আমরা আশাবাদী প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং সেখানেও ইসলামী ছাত্রশিবির ইনশাআল্লাহ মেজরিটি ভোটে বিজয়ী হবে।

জাগো নিউজ: জাতীয় নির্বাচনেও কি তরুণদের ভোটের এমন প্রতিফলন দেখা যাবে?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: যারা ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে এতদিন অপপ্রচার করেছে, আমাদের ট্যাগ দিয়েছিল তাদের জন্য এটা একটা ‘আইস ব্রেক’। আমরা ইসলাম ও দেশের জন্য, মানুষের জন্যই কাজ করি।

এখন তরুণ ভোটাররা সচেতন। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, ইউটিউব, সবখানে তারা সব কিছু দেখে, বোঝে। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচি দেখে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে ভোট দেয়—এ শিক্ষা জাতীয় নির্বাচনেও প্রযোজ্য হবে ইনশাআল্লাহ।

জাগো নিউজ: ছাত্রদল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে একটি পদেও জয় পায়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কিছু পদে নির্বাচিত হয়েছে। আপনাদের ও তাদের পলিসির মূল পার্থক্য কোথায়?

নুরুল ইসলাম সাদ্দাম: আমাদের রাজনীতি গঠনমূলক ও শিক্ষার্থীবান্ধব। অন্য দলগুলোর নিজস্ব কোনো এজেন্ডা ছিল না। তারা শুধু ‘মব ক্রিয়েশন’ করে, গ্যাঞ্জাম করতো। শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনমূলক কাজ করে না। আমরা ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা দিবস পালনসহ অযথা বড় বড় কর্মসূচি দিইনি। আমরা মনে করি আমাদের প্রতিটি কাজ শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।

আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানেও তারা হামলা করেছে। তাদের রাজনীতি শুধু ফ্রেমিং ও হিংসার ওপর নির্ভরশীল। তাদের গত এক বছরের যে অ্যাটিটিউড ছিল, সেটা শিক্ষার্থীরা মাথায় রেখেই ভোট দিয়েছে। আমাদের প্রতিটি কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের জন্য।

আরএএস/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article