২০১০ সাল নাগাদ তার নেতৃত্বেই ঘুরে দাঁড়ায় অগ্রণী ব্যাংক। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ফের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। ব্যাংকটি আবারও বেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। খেলাপি ঋণ ৪২ শতাংশ ছুঁই ছুঁই, ক্যাপিটাল ঘাটতি প্রকট, শীর্ষ করপোরেট শাখাগুলো পর্যন্ত লোকসানে।
ব্যাংকের বর্তমান সংকট, সম্ভাবনা ও উত্তরণের পথ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপন।
জাগো নিউজ: আপনি ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। সে সময় ব্যাংকের কী অবস্থা ছিল?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: ২০০৪ সালে যখন ব্যাংকটি আমি টেকওভার করি, তখন সব ইন্ডিকেটর নেগেটিভ ছিল। ক্যাপিটাল ছিল নেগেটিভ, খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪০ শতাংশের ওপরে, ক্যামেলস (CAMELS) রেটিং ছিল খারাপ। ২০০৪ সালে ইক্যুইটি ছিল নেগেটিভ ২২শ কোটি টাকা, আমি সেটা ২০১০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ পজিটিভে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। লোকসানি শাখা ছিল ৪৪৭টি, তা কমিয়ে ৭৭টিতে নিয়ে এসেছিলাম। অথচ কোনো শাখা বন্ধ করিনি কিংবা কাউকে চাকরিচ্যুতও করিনি। স্টাফরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিল, আর সে কারণেই ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
জাগো নিউজ: আপনি ২০২৪ সালে আবার অগ্রণীর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন ব্যাংকের অবস্থা কেমন দেখেন?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: খুবই অবিশ্বাস্য লেগেছে। ক্যাপিটাল যেটা আমি রেখে গিয়েছিলাম ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, সেটা এসে দাঁড়ায় মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশে। খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে। শাখার দিক থেকে অবশ্য কিছু উন্নতি হয়েছে— লোকসানি শাখা ৭৭টি থেকে কমে এসেছে ২৫টিতে। তবে করপোরেট ও প্রধান শাখাগুলো লোকসানে গেছে, যা আগে ছিল না।
আমাদের মূল ফোকাস এখন রিকভারি ও পুনঃতফসিলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে যেসব লোন রিশিডিউল করা সম্ভব, সেগুলো করছি। গত এক বছরে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করতে পেরেছি এবং ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছি
জাগো নিউজ: এতটা খারাপ অবস্থার মূল কারণ কী বলে মনে করেন?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব ও নিয়ম না মেনে, রাজনৈতিক তদবিরে লোন দিয়ে খেলাপির পরিমাণ বাড়ানো। ঋণ দেওয়া হয়েছে কিন্তু ফলোআপ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রজেক্ট ঋণ দিয়েছে যেগুলো পরবর্তীসময়ে পরিচালনাই সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন
- এবি ব্যাংককে শক্তিশালী-বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে চাই
- সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ক্লিনিং অপারেশনে যাচ্ছে এসআইবিএল
- ‘গলার কাঁটা’ খেলাপি ঋণ, ৫ বছরে বেড়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা
জাগো নিউজ: আপনি এখন কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আমাদের মূল ফোকাস এখন রিকভারি ও পুনঃতফসিলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে যেসব লোন রিশিডিউল করা সম্ভব, সেগুলো করছি। গত এক বছরে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করতে পেরেছি এবং ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছি।
জাগো নিউজ: বর্তমান জনবল পরিস্থিতি কেমন?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আগে ছিল ১৪ হাজার স্টাফ, এখন সেটা নেমে এসেছে ১০ হাজারে। যেসব কর্মকর্তা তিন বছর ধরে একই টেবিলে বসে আছেন, তাদের অন্য শাখায় রোটেট করছি। এটি ইতিবাচক দিক, কারণ দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকলে অনেক সমস্যা তৈরি হয়।
জাগো নিউজ: রেমিট্যান্সের দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থান কোথায়?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আমরা সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষস্থানে এবং ৬১ ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আমাদের ৯৭৯টি শাখার প্রত্যেকটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনো গ্রাহক হয়রানির শিকার না হন। গ্রামীণ শাখাগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ৮৬টি বিদেশি এজেন্সি রয়েছে, তারা রেমিট্যান্সপ্রবাহে সহায়তা করে।
আমাদের ৯৭৯টি শাখার প্রত্যেকটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনো গ্রাহক হয়রানির শিকার না হন। গ্রামীণ শাখাগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ৮৬টি বিদেশি এজেন্সি রয়েছে, তারা রেমিট্যান্সপ্রবাহে সহায়তা করে
জাগো নিউজ: ডেফারেল লসের বিষয়ে কিছু বলবেন?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: ডেফারেল লস এখন ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১০ সালে আমার সময়ে পোর্টফোলিও ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যার ১০ শতাংশ খেলাপি ছিল। এখন পোর্টফোলিও দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার কোটিতে, যার ৪২ শতাংশ খেলাপি! এটা স্পষ্ট যে গত ১৫ বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে বিশাল অংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
জাগো নিউজ: খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও আদায়ে আর কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-নীতি মেনে পুনঃতফসিল করছি, গ্রুপভিত্তিক ঋণ যারা খেলাপি হয়েছে তাদের শনাক্ত করে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় আনার চেষ্টা করছি। প্রায় ২১৫টি প্রজেক্ট লোনের মধ্যে ২০০টি খেলাপি, তাদের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছি।
জাগো নিউজ: ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: ২০১০ সালে আমাদের সম্পদ ছিল ২৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে তা এক লাখ ২৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৩৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্পদে, কিন্তু মুনাফায় হয়নি। কারণ, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে প্রায় ৮ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আমাদের লক্ষ্য, আগামী তিন বছরে অগ্রণী ব্যাংককে একটি স্থিতিশীল, লাভজনক ও শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলা। এটি সময়সাপেক্ষ, তবে আমি আশাবাদী।
জাগো নিউজ: কোন অবস্থায় নিতে চান অগ্রণী ব্যাংককে?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: অগ্রণী ব্যাংককে আবারও শীর্ষ অবস্থানে দেখতে চাই। কারণ, এ ব্যাংকের রয়েছে একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। দেশভাগের আগে হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংকের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছিল অগ্রণী ব্যাংক। সেই সময় হাবিব ব্যাংক ছিল একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান, যারা তাদের গ্রাহকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতো। আমরা সেই ঐতিহ্যই ধরে রাখতে চাই—গ্রাহকদের গুরুত্ব দিয়ে, সেবা দিয়ে, বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে।
অগ্রণী ব্যাংককে আবারও শীর্ষ অবস্থানে দেখতে চাই। কারণ, এ ব্যাংকের রয়েছে একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। দেশভাগের আগে হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংকের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছিল অগ্রণী ব্যাংক
বর্তমানে ব্যাংকটি বড় একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, বিশেষ করে গ্রুপভিত্তিক ঋণের কারণে। অনেক গ্রুপের ঋণের এক্সপোজার এখন এতটাই বেশি যে না পরিশোধ করতে পারছে, না পরিচালনা করতে পারছে। ২১৫টি প্রকল্পভিত্তিক ঋণের মধ্যে প্রায় ২০০টিই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ঋণের বোঝা বহন করতে না পেরে অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছে, আবার অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজ নিচ্ছি এবং প্রয়োজনে পুনঃতফসিল ও কাঠামোগত সমাধানের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা করছি। খেলাপি ঋণ যেন সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেজন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। আমি আশাবাদী, শিগগির অগ্রণী ব্যাংক খেলাপিমুক্ত হয়ে আবারও তার আগের মর্যাদা ও অবস্থানে ফিরে যাবে।
জাগো নিউজ: আপনার চূড়ান্ত বার্তা কী হবে?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: ব্যাংক একটি আস্থার জায়গা। আমাদের কাছে এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার গ্রাহক আমানত রয়েছে— এটা আমাদের প্রতি জনগণের আস্থার প্রতীক। এখন আমাদের লক্ষ্য, সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংককে আবারও দেশের সেরা ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। চ্যালেঞ্জ অনেক, তবে আমাদের ইচ্ছাশক্তি আছে।
ইএআর/এএসএ/ এমএফএ/এমএস