শীত থেকে বাঁচতে বরফের ব্লকের তৈরি ঘরে থাকেন তারা

বরফ আমাদের কাছে হয়তো ভ্রমণের রোমাঞ্চ, ছবি তোলার আনন্দ বা শীতের স্মৃতি। কিন্তু পৃথিবীর এক প্রান্তে আছে এমন এক জনগোষ্ঠী, যাদের কাছে বরফ মানেই জীবন, সংস্কৃতি এবং টিকে থাকার প্রতিদিনের সংগ্রাম। এমনই এক জনগোষ্ঠী আছেন, যারা ইনুইট আর্কটিক অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ, যারা কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আলাস্কা এবং সাইবেরিয়ার বরফে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছে। চারদিকে অসীম বরফ, হিমেল বাতাস আর শূন্যতার মাঝেও তারা গড়ে তুলেছে এক অসাধারণ জীবনযাত্রা, যার প্রতিটি মুহূর্ত জুড়েই রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের গল্প। শীতের তীব্রতা এখানে কল্পনার বাইরে। অনেক সময় তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। দিনের পর দিন সূর্য ওঠে না, রাত যেন কখনো শেষই হয় না। নদী-সমুদ্র সব বরফে ঢেকে যায়, চারদিকে শুধু সাদা সাদা বিস্তীর্ণ সমুদ্রভূমি। এমন পরিবেশে ফসল ফলানো তো দূরের কথা, গাছপালাও জন্মায় না ঠিকমতো। অথচ এই কঠিন প্রকৃতির মাঝেই ইনুইটরা শিখে নিয়েছে প্রকৃতিকে জেতা যায় না, বরং তার সঙ্গে মানিয়ে চললেই টিকে থাকা যায়। এই মানিয়ে চলার গল্পের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে আছে তাদের বরফের ঘর ইগলু। আমাদের

শীত থেকে বাঁচতে বরফের ব্লকের তৈরি ঘরে থাকেন তারা

বরফ আমাদের কাছে হয়তো ভ্রমণের রোমাঞ্চ, ছবি তোলার আনন্দ বা শীতের স্মৃতি। কিন্তু পৃথিবীর এক প্রান্তে আছে এমন এক জনগোষ্ঠী, যাদের কাছে বরফ মানেই জীবন, সংস্কৃতি এবং টিকে থাকার প্রতিদিনের সংগ্রাম। এমনই এক জনগোষ্ঠী আছেন, যারা ইনুইট আর্কটিক অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ, যারা কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আলাস্কা এবং সাইবেরিয়ার বরফে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছে। চারদিকে অসীম বরফ, হিমেল বাতাস আর শূন্যতার মাঝেও তারা গড়ে তুলেছে এক অসাধারণ জীবনযাত্রা, যার প্রতিটি মুহূর্ত জুড়েই রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের গল্প।

শীতের তীব্রতা এখানে কল্পনার বাইরে। অনেক সময় তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। দিনের পর দিন সূর্য ওঠে না, রাত যেন কখনো শেষই হয় না। নদী-সমুদ্র সব বরফে ঢেকে যায়, চারদিকে শুধু সাদা সাদা বিস্তীর্ণ সমুদ্রভূমি। এমন পরিবেশে ফসল ফলানো তো দূরের কথা, গাছপালাও জন্মায় না ঠিকমতো। অথচ এই কঠিন প্রকৃতির মাঝেই ইনুইটরা শিখে নিয়েছে প্রকৃতিকে জেতা যায় না, বরং তার সঙ্গে মানিয়ে চললেই টিকে থাকা যায়।

এই মানিয়ে চলার গল্পের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে আছে তাদের বরফের ঘর ইগলু। আমাদের কাছে বরফের ঘর মানেই আরও বেশি ঠান্ডা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, বরফ আসলে চমৎকার একটি ইনসুলেটর। ইনুইটরা শক্ত এবং ঘন বরফের ব্লক কেটে গম্বুজ আকারে সাজিয়ে তৈরি করে ইগলু। ভেতরের গঠন এমনভাবে তৈরি করা হয় যে ঠান্ডা বাতাস নিচে জমা থাকে এবং উষ্ণ বাতাস ওপরে থাকে। দরজাটি রাখা হয় খুব নিচু এবং ছোট, যাতে ঝোড়ো বাতাস সরাসরি ভেতরে ঢুকতে না পারে। কখনো কখনো দরজার পাশে বরফের ছোট টানেলও বানানো হয়, যা ঠান্ডা বাতাসকে অনেকটাই আটকে দেয়।

শীত থেকে বাঁচতে বরফের ব্লকের তৈরি ঘরে থাকেন তারা

ইগলুর ভেতরে মেঝেতে বিছানো হয় পশুর চামড়া, উল এবং কোমল ফারের স্তর। ইনুইটরা ভেতরে ছোট্ট আগুন জ্বালায় কিংবা তেলের বাতি ব্যবহার করে। এই তাপ বরফের দেয়াল গলিয়ে না দিয়ে বরং অল্প একটু নরম করে ফেলে, পরে আবার জমে দেয়ালটিকে আরও মজবুত করে তোলে। ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় অনেকটাই উষ্ণ হয়ে ওঠে অনেক সময় ০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেও থাকতে পারে, যা বরফের দেশে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা। আশ্চর্যের বিষয়, ইগলুর গঠন যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা তৈরি করা বেশ জটিল দক্ষতার কাজ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শেখানো হয়।

খাবারের জন্য তাদের ভরসা সমুদ্র। মাছ, সিল, ওয়ালরাস, ক্যারিবু হরিণ এসবই ইনুইটদের প্রধান খাদ্য। বরফের ওপর ছোট গর্ত করে মাছ ধরা, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শিকার করা এসবই তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। অনেক সময় তারা কাঁচা মাছ বা মাংসও খায়, কারণ এতে থাকে ভিটামিন সি, যা অন্য কোনো উৎস থেকে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই খাদ্যাভ্যাস শুধু প্রয়োজনই নয়, বরং টিকে থাকার অপরিহার্য অংশ।

শীত থেকে বাঁচতে বরফের ব্লকের তৈরি ঘরে থাকেন তারা

যাতায়াতে তাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিল কুকুর-স্লেজ। শক্তিশালী হাস্কি কুকুররা বরফের ওপর স্লেজ টেনে মানুষ ও মালামাল বহন করত। বরফের দেশে এটি শুধু যানবাহন নয়, জীবনরক্ষাকারী উপায়ও ছিল। একইভাবে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি মোটা পোশাক, ফার-লাইনড জুতা ও হুডযুক্ত কোট তাদের শরীরকে ঠান্ডা ও বাতাস থেকে সুরক্ষা দিত। ইনুইটদের ঐতিহ্যবাহী ‘পার্কা’ এখন বিশ্বজুড়েই পরিচিত শীতের পোশাক।

তাদের সমাজ ছিল পরিবারভিত্তিক এবং সহযোগিতামূলক। কঠোর প্রকৃতিতে একা বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। তাই শিকার, রান্না, খাদ্য সংরক্ষণ সব কিছুই ভাগাভাগি করে করা হতো। রাতে আগুনের পাশে বসে গল্প বলা ছিল একটি বড় সামাজিক অনুষঙ্গ। সেই গল্পে থাকত প্রকৃতি, ইতিহাস, শিকার আর আত্মার কাহিনি যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলেছে।

ইনুইটদের একটি বিশেষ বিশ্বাস হলো, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানেরই আত্মা আছে। তাই তারা শিকারের আগে ও পরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। অতিরিক্ত শিকার না করা, সমুদ্রকে সম্মান করা এসব ছিল তাদের নৈতিক নিয়ম। প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং সহাবস্থান এটাই ছিল তাদের দর্শন।

আর্কটিক অঞ্চলের রাতের আকাশও ইনুইটদের জীবনের এক বিস্ময়কর অংশ। অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস তাদের সংস্কৃতিতে বিশেষ অর্থ বহন করে। কেউ কেউ একে আত্মাদের নৃত্য বলে বিশ্বাস করত, কেউ দেখত দেবতাদের বার্তা হিসেবে। বরফাচ্ছন্ন নীরব এ পৃথিবীতে এই আলোকচ্ছটা যেন এক জাদুকরি অনুভূতি এনে দেয়।

শীত থেকে বাঁচতে বরফের ব্লকের তৈরি ঘরে থাকেন তারা

তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ ইনুইটদের জীবন অনেকটাই বদলে গেছে। আধুনিক ঘরবাড়ি, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রযুক্তি তাদের জীবনে সুবিধা এনে দিলেও জলবায়ু পরিবর্তনে বরফ গলতে শুরু করেছে, কমে যাচ্ছে শিকারক্ষেত্র। তাদের ভাষা ও ঐতিহ্যও এখন হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে। তারপরও তারা নিয়মিত চেষ্টা করছে নিজের সংস্কৃতি, গল্প, পোশাক, খাবার ও জীবনদর্শন ধরে রাখতে।

ইনুইটদের বেঁচে থাকার এই গল্প আসলে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার এক অনন্য উদাহরণ। প্রকৃতি যতটাই কঠোর হোক, মানুষ যদি এক থাকে, একে অপরের পাশে দাঁড়ায় এবং পরিবেশকে শ্রদ্ধা করতে শেখে, তবে টিকে থাকার পথ সে খুঁজে নেয়ই। বরফঢাকা সেই সভ্যতার গল্প তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় উষ্ণতা শুধু আগুনে নয়, থাকে মানুষের একতা, সম্পর্ক আর সাহসের ভেতরেই।

আরও পড়ুন
সন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে
এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কী, খরচ কেমন?

সূত্র: ব্রিটানিকা, বিবিসি

কেএসকে/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow