শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)

2 hours ago 7

শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) দক্ষিণ এশিয়ার সুফি ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি শুধু আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যই নয়, বরং নৈতিক জীবন, মানবতাবোধ ও সমাজ সংস্কারের জন্যও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার পূর্ণ নাম শেখ ফখরুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর। জন্ম ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (৫৬৯ হিজরি) পাঞ্জাবের মুলতান অঞ্চলের কোতওয়াল গ্রামে। তার পিতার নাম শেখ জালালউদ্দিন সুলায়মান ও মাতার নাম বিবি মরিয়ম। পারিবারিকভাবে তারা কোরাইশ বংশোদ্ভূত ছিলেন।

শেখ ফরিদ শৈশবকালেই ধর্মশিক্ষা লাভ করেন। তার মাতা ছিলেন অতি ধার্মিক নারী, যিনি সন্তানকে ইমান, তাকওয়া ও ধৈর্যের পথ দেখিয়েছিলেন। বলা হয়, ফরিদ ছোটবেলায় একবার মায়ের কাছে জানতে চাইলেন, ‘যদি কেউ বেশি নামাজ পড়ে তবে কি আল্লাহ খুশি হন?’ তখন তার মাতা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, তবে সঠিক নিয়ত ও ধৈর্যের সঙ্গে হলে।’ এ শিক্ষাই তাকে আজীবন আল্লাহর পথে অবিচল রাখে।

শেখ ফরিদ জ্ঞানার্জনের জন্য মুলতান, কাবুল ও বুখারায় ভ্রমণ করেন। তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং ইসলামী জ্ঞান, তাফসির, হাদিস ও ফিকহে পারদর্শী হন। তবে তার মূল ঝোঁক ছিল আধ্যাত্মিক সাধনা। এজন্য তিনি খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির (রহ.) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার মাধ্যমে ফরিদ চিশতিয়া তরিকার অন্তর্ভুক্ত হন। গুরু তাকে কঠোর মুজাহাদা ও রিয়াজতের শিক্ষা দেন। ফরিদ মাসের পর মাস রোজা রাখতেন, দিনের পর দিন অল্প আহারে কাটাতেন এবং রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এজন্যই তিনি ‘গঞ্জেশকর’ উপাধিতে ভূষিত হন, যার অর্থ ‘শস্য ও ধৈর্যের ভান্ডার’।

তার আধ্যাত্মিক জীবন শুধু ব্যক্তিগত সাধনায় সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি সমাজের দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের জন্যও ছিলেন আশ্রয়স্থল। তার দরবার সর্বদা মানুষের জন্য খোলা থাকত। তিনি প্রেম, করুণা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা প্রচার করতেন। কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদে তার কাছে ছিল না। তার কাহিনিগুলোতে দেখা যায়, তিনি ন্যায় ও সত্যের পথে আপসহীন ছিলেন, আবার মানুষের প্রতি ছিলেন অগাধ দয়ালু।

শেখ ফরিদের কবিতা ও বাণী আজও পাঞ্জাবি সাহিত্য ও সুফি কাব্যের অমূল্য সম্পদ। তার রচিত শ্লোকগুলোতে আল্লাহর প্রেম, দুনিয়ার অস্থায়িত্ব, নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষা পাওয়া যায়। পাঞ্জাবি ভাষার প্রাচীন কাব্যধারায় তার অবদানকে মৌলিক হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক গবেষক মনে করেন, তার কবিতা শুধু সুফি দর্শনের ব্যাখ্যাই নয়, বরং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সত্য ও ন্যায়ের বাণী পৌঁছে দেওয়ার সহজতম মাধ্যম।

তার জীবনের শেষভাগ কেটেছে পাকিস্তানের বর্তমান পাঞ্জাব প্রদেশের পাকপত্তনে। এখানেই তার খানকাহ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি অসংখ্য শিষ্যকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেন। ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে (৬৬৪ হিজরি) শেখ ফরিদ ইন্তেকাল করেন। পাকপত্তনে তার মাজার আজও লাখো মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতি বছর ওরস উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষ সেখানে সমবেত হয়।

শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) ছিলেন সত্যিকার অর্থে দক্ষিণ এশিয়ার সুফি ঐতিহ্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তার জীবনধারা ও বাণী আজও মানুষকে সঠিক পথে চলতে, নৈতিক জীবনযাপন করতে এবং মানবতার সেবা করতে উদ্বুদ্ধ করে।

Read Entire Article