ফরিদপুর-৩ আসনের (সদর) সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন মাত্র ১০ বছর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। তার অনুসারীরাও দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে অভিযুক্ত। দেশের বহুল আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় তাদের অনেকে এখনো জেলে। তবে দুর্নীতির মহোৎসব চললেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তখন বেঁচে যান তিনি। সেই থেকে দেশছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফরিদপুরে এখন বিরান পড়ে আছে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের তিনটি জৌলুসপূর্ণ বাড়ি। যার বর্তমান বাজার মূল্য শত কোটি টাকা। একসময় ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাড়িঘরগুলো এখন খাঁ খাঁ এক বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এখন বিরান পড়ে আছে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের তিনটি জৌলুসপূর্ণ বাড়ি। যার বর্তমান বাজার মূল্য শত কোটি টাকা। একসময় ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাড়িঘরগুলো এখন খাঁ খাঁ এক বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার শ্রমমন্ত্রী, পরেরবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের মিডনাইট ইলেকশনেও এমপি হন তিনি।
আফসানা মঞ্জিল নামের সেই বাড়িটি-ছবি জাগো নিউজ
- আরও পড়ুন
- ডুপ্লেক্স বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ, ‘দেশ ছেড়েছেন’ শামীম ওসমান
- দুই মায়ের নামে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় খুলে লোক ঠকাতেন নুরুজ্জামান
খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাবেক স্বামী। ওই ক্ষমতার বলয়েই এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। খন্দকার মোশাররফের হেলমেট বাহিনীর হাতে শুধু বিএনপি নেতারাই নন, আওয়ামী লীগের অনেকেও হামলা-নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অতিশয় নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের পথ বেছে নেন। অনেকের কাছ থেকে জোর করে জমিজমা লিখে নেন। যারা লিখে দিতে চাননি তাদেরটা জোর করেই কেড়ে নিতেন তিনি।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদে এমপি ও মন্ত্রী হয়ে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিশেষ বাহিনী তৈরি করে দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেন। তখন থেকেই বাড়ি তৈরির বিলাসিতায় মেতে ওঠেন তিনি। এর মধ্যে শহরের বদরপুর, কমলাপুর ও ডিক্রিরচরে সরকারি খাস ও ব্যক্তিমালিকানার একের পর এক জায়গাজমি দখল করে জেলা সদরেই নির্মাণ করেন বিলাসবহুল ও নয়নাভিরাম তিনটি বাড়ি। এর বাইরেও রয়েছে তার পৈতৃকভিটার আরও দুটি বাড়ি।
বাড়ির ভেতরের ভাস্কর্য-ছবি জাগো নিউজ
দুর্নীতি ও দখলবাজির কেলেঙ্কারিতে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে পতন হয় তার। ২০২০ সালের জুনে তার আসনে কথিত এক শুদ্ধি অভিযানের পর ওই বছরের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার বাবরসহ মোশাররফ অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের একটি মামলা করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ। ওই শুদ্ধি অভিযানে খন্দকার মোশাররফের একের এক আস্থাভাজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে অনেকে গাঢাকা দেন। হত্যাসহ অসংখ্য মামলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢোকানো হয়।
শেখ হাসিনার বেয়াই খন্দকার মোশাররফ-ছবি জাগো নিউজ
- আরও পড়ুন
- দুদকের মামলায় হাইকোর্টে ওসি প্রদীপের স্ত্রীর জামিন
- দণ্ড থেকে খালাস পেলেন গিয়াস উদ্দিন আল মামুন
ওই মামলায় খন্দকার মোশাররফের ভাই বাবরকে মানি লন্ডারিংয়ের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেন বিচারিক আদালত। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।
ফরিদপুরের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে শহরের প্রবেশমুখে বদরপুরে ‘আফসানা মঞ্জিল’ নামের বাড়িটিতে সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ বিঘার মতো জমি রয়েছে। যার মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে ছিল মাত্র দুই বিঘার মতো। বাকি সবটুকুই জোর করে নেওয়া। এখনো তার লোকেরা ওইসব জমির প্রকৃত মালিকদের হুমকি দিচ্ছে।
যদিও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শেখ হাসিনার বেয়াই পরিচয়ের সুবাদে এলজিআরডিসহ সাবেক একাধিক মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাটিয়ে শিষ্য সাগরেদদের এই দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অবৈধ টাকা উপার্জনের মূল অবলম্বন ছিলেন খন্দকার মোশাররফ। যার সুবাদেই তিনি গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার এসব সম্পদ। অথচ ওই মামলায় তার ছোট ভাই খন্দকার বাবরকে আসামি করা হলেও আত্মীয়তার সুবাদে তিনি পার যান।
বাড়িগুলো এখন খাঁ খাঁ করছে-ছবি জাগো নিউজ
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সম্প্রতি সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আমার ১০ শতাংশ জায়গাসহ আরও তিনজনের পাঁচ শতাংশ জায়গা দখল করে গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা আমাদের জমি দখলমুক্ত চাই।—ভুক্তভোগী প্রশান্ত কুমার রায়
স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অতিশয় নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপরে নির্মম নির্যাতনের পথ বেছে নেন। এতে অনেকের কাছ থেকে জোর করে জমাজমি লিখে নেন। যারা লিখে দিতে চাননি তাদেরটা জোর করেই কেড়ে নিতেন তিনি।
একাধিক ব্যক্তি বলেন, ফরিদপুরের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে শহরের প্রবেশমুখে বদরপুরে ‘আফসানা মঞ্জিল’ নামের বাড়িটিতে সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ বিঘার মতো জমি রেয়েছে। যার মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে ছিল মাত্র দুই বিঘার মতো জমি। বাকি সবটুকুই জোর করে নেওয়া। এখনো তার লোকেরা ওইসব জমির প্রকৃত মালিকদের হুমকি দিচ্ছে।
ভুক্তভোগী প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, আমার ১০ শতাংশ জায়গাসহ আরও তিনজনের পাঁচ শতাংশ জায়গা দখল করে গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা আমাদের জমি দখল মুক্ত চাই।
সদর উপজেলার ডিক্রিরচরে রয়েছে নামে-বেনামে কয়েকশ বিঘা সম্পত্তি। বিস্তীর্ণ জমিজুড়ে গড়ে ওঠা খন্দকার মোশাররফের বাংলো বাড়িটি পরিচিত ছিল রঙমহল হিসেবে। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পী এনে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
এভাবেই পড়ে আছে সব-ছবি জাগো নিউজ
আর শহরের দক্ষিণ কালিবাড়িতে রাজেন্দ্র কলেজ সংলগ্ন পৈতৃক বাড়ির পাশে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি তিনি লিখে নেন। সেসময় এ নিয়ে হইচই ওঠে। তবে সবই তিনি ম্যানেজ করে এখানেও গড়ে তোলেন বিলাসবহুল আরেকটি বাংলো বাড়ি। যদিও বাড়িটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।
শেখ হাসিনার বেয়াইবাড়ি-ছবি জাগো নিউজ
গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা আফসানা মঞ্জিলের প্রকৃত রূপ আসলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বড় গেট মাড়িয়ে পিচঢালা পথ পেরিয়ে তবেই দেখা মেলে বাংলো প্যাটার্নের এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটির। এই অঞ্চলে এমন বিলাসী বাড়ি আরেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু বাড়ি বললে ভুল হবে। কী নেই সেখানে! সরকারি প্রটোকল, গার্ড অব অর্নার নেওয়ার জন্য তৈরি পতাকার স্ট্যান্ড সম্বলিত বেদি। আছে বিচিত্র প্রজাতির জন্তু-জানোয়ার। এগুলো অনেকটা ছোট চিড়িয়াখানাও বলা যায়। এসব জৌলুসপূর্ণ বাড়ি নির্মাণে টাকার উৎস কী, সেটিই সবার প্রশ্ন।
- আরও পড়ুন
- আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে দুর্নীতি কমবে না
- ভারত সব প্রতিবেশীকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে
এসব ব্যাপারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বা তার পরিবারের বক্তব্য জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ দেশে না থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।
এভাবেই আড়ালে চলে গেছেন খন্দকার মোশাররফ-ছবি জাগো নিউজ
শহরের বদরপুরের বাড়িতে গিয়ে কেয়ারটেকার বিল্লালের কাছে তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর চাইলে তিনি যোগাযোগ করে জানাবেন বললেও পরে আর তা দিতে পারেননি। অবশ্য এরই মাঝে তাদের একজন বিশ্বস্ত নারী এসে তার মোবাইল থেকে কথা বলিয়ে দেন খন্দকার মোশাররফের জামাতা সাবেক এমপি কায়েদ-ই-মিল্লাতের সঙ্গে।
কায়েদ-ই-মিল্লাত জানান, ফরিদপুরে তার শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এসব সম্পত্তির বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। তবে ক্ষমতার বদল হওয়ায় অনেকে অনেক কথাই বলছেন।
এনকেবিএন/এসএইচএস/জিকেএস