বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় চারজনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৯৮ জনের বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা চারটি দায়ের করা হয়। চারটি মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। আরেকটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
শেখ হাসিনা-রেহানা-জয় ও পুতুলের বিরুদ্ধে মামলা
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদের আদালতে মামলাটি করা হয়। নিহত যুবক ফরিদ শেখের বাবা সুলতান মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আন্দোলন চলাকালে ফরিদ শেখ যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন। এসময় শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা চালানোর সময় পুলিশের গুলির আঘাতে মারাত্মক জখম হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আশপাশের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ফরিদ শেখের পাকস্থলির ডান পাশে লেগে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি। মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ফরিদ শেখ মারা যান।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক কমিশনার ডিএমপি হাবিবুর রহমান, জাসদের হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত, যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান।
শেখ হাসিনা-কাদের-কামালসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন নিহত কলেজছাত্রের মা কুলছুমা আক্তার। এসময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ওমর ফারুক মোহাম্মাদপুর থানাধীন কালভার্ট ফুট ওভারব্রিজের নিচে আন্দোলোনকারীদের মাঝখানে পড়ে যান। এসময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানন প্রমুখ।
গার্মেন্টসকর্মী হত্যায় হাসিনাসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কোটা আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর আদাবর এলাকায় গার্মেন্টসকর্মী সোহেল রানাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালতে এ মামলার আবেদন করেন নিহতের ভাই মো. ইব্রাহীম। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ঢাকার আদাবর থানা পুলিশকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন।
শেখ হাসিনা ব্যতীত মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, মাইনুল ইসলাম খান নিখিল, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ভিকটিম পেশায় একজন গার্মেন্টকর্মী। দেশব্যাপী কোটা আন্দোলনের সময় গত ৫ আগস্ট আদাবর থানা এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছিল। সে সময় স্বৈরশাসকের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীরা তথা আসামিরা এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ভিকটিমসহ ঘটনাস্থলে আসামিদের গুলিতে একাধিক নিহত ও অনেকেই আহত হন। এসময় গুলিবিদ্ধ হলে ভিকটিম সোহেল রানাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শিশু হত্যার আসামি শেখ হাসিনাসহ ৮৫ জন
কোটা আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় শিশু তামীম শিকদারকে (১৩) গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ জুলাই) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আফনান সুমীর আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহতের দাদী মোছা. কোহিনূর। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে রামপুরা থানাকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন।
শেখ হাসিনা ছাড়া মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান,
সাবেক এমপি মো. ওয়াকিল উদ্দিন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মো. হাসান মাহমুদ।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ১৯ জুলাই বিকাল ৪.৩০ টার দিকে ডিআইটি রোডের সম্মুখে হাজার হাজার ছাত্র জনতা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিলেন। সেই আন্দোলনের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। উক্ত সময় ভিকটিম তামীম শিকদার (১৩) রাস্তা পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যান। বুলেট তার বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।
পরে তার দাদী স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ভিকটিমকে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিরীহ তামিম শিকদার মৃত্যুবরন করেন কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে কোন মামলা গ্রহণ করে নাই। পরবর্তীতে ভিকটিমের দাদী বর্ণিত মামলার বাদিনী নিহত তামিম শিকদারকে পূর্ব রামপুরা মোল্লা বাড়ী বাজার সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন কার্য সম্পন্ন করেন।
বিইউবিটি শিক্ষার্থী হত্যা: হাসিনাসহ ১৮ জনের নামে মামলা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুজন মাহমুদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে এ মামলার আবেদন করেন নিহতের ভাই সুলতান মাহমুদ। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য মিরপুর মডেল থানা পুলিশকে আদেশ দেন। জানা যায়, নিহত সুজন মাহমুদ ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী।
শেখ হাসিনা ব্যতিত এ মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী মো. আনিসুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক এমপি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক এমপি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সাবেক এমপি দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক এমপি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সাবেক মন্ত্রী কামাল আহম্মেদ মজুমদার ও সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লা।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট এক দফার সরকার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ চলাচলে বেলা ১২.৩০ মিনিটের দিকে গুলিবিদ্ধ হন
সুজন মাহমুদ। এরপর তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জেএ/এমআইএইচএস