শ্বেতপত্র ও আমাদের করণীয়

3 hours ago 4

শিক্ষার্থী জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্যে গঠিত কমিশন প্রণীত শ্বেতপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে তা থেকেউত্তরণের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। কমিশনের শেতপত্র দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে, সেটা আমাদের জন্য যেমন হতাশার তেমনি এই শ্বেতপত্রের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো সকলের মধ্যে একটি আশার সঞ্চারও করেছে। এই শ্বেতপত্রে বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সীমাহীন দুর্নীতি, আর্থিক কারচুপি, অর্থ পাচার ও লুটপাট সহ নানাবিধ খাতকে চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটা খাতের বাস্তবিক এবং ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরা হয়। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত প্রতিটা খাতের দুর্নীতির অসহনীয় অবস্থান এখানে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়।

অর্থনীতির প্রতিটা খাতের ভয়াবহ ভঙ্গুর দশা চিহ্নিত করা হলেও এই শ্বেতপত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাতটি প্রধান খাতকে চিহ্নিত করা হয় যেখানে অতিসত্বর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ জরুরী বলে এই এই শ্বেতপত্রে প্রকাশ করা হয়। সেগুলো হলো অর্থনীতির মধ্যে স্থিরতা নিয়ে আসা; আসন্ন ২০২৫ এবং ২৬ সালের বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পরিষ্কার ধারণা তৈরি করা; ২০২৫ থেকে ২৭ সালকে বিবেচনায় নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং এর সাথে সম্প্রতি স্থগিত হয়ে যাওয়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যথাযথ মূল্যায়ন করা; অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতকে চিহ্নিত করা; এল ডি সি (স্বল্পোন্নত দেশে থেকে অধীকতর উন্নত দেশে উন্নয়ন) গ্রাজুয়েশনের জন্য শক্তিশালী নীতিমালা গ্রহণ; এসডিজি'র লক্ষ্যমাত্রা দ্রুত গতিতে অর্জনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া; উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সংলাপ এর জন্যে একটি ফোরাম তৈরি করা।

এটি বলার অপেক্ষায় রাখে না যে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য এই শ্বেতপত্রের নির্দেশিত পদক্ষেপ গুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ? একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রভাব কেমন হতে পারে এই দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ ক্রমশ টের পাচ্ছে। নিম্ন স্তরের মানুষ থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষ নানাভাবে এই ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বলী হিসেবে তাদের জীবনযাপন করে আসছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শ্বেতপত্র প্রণীত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেক্টর গুলোর পুনরুজ্জীবন এর কোন বিকল্প নেই।

এই শ্বেতপত্রে সংস্কার প্রক্রিয়ায় যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যকার যে স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত বাধা রয়েছে তা থেকে উত্তরণ। যা দেশের সুশাসন ও অর্থনীতির একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরীর জন্য অত্যাবশ্যক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে নেয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়ার সাথে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই কমিশন সংস্কারের জন্য আরও ছয়টি খাতকে চিহ্নিত করে: ব্যাংক, এনার্জি এবং পাওয়ার, রাজস্ব, অবৈধ অর্থ পাচার, রাষ্ট্রীয় খরচ বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্প এবং সামগ্রিক তথ্য ব্যবস্থাপনা।

এসব বাস্তবায়নের জন্য একটি বৃহৎ এবং শক্তিশালী একটি প্রায়োগিক ও সমন্বিত সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন করা অতিব জরুরী। গুরুত্ব বিচারে অর্থনৈতিক এই সকল সংস্কার প্রস্তাবনা সত্যিকার অর্থেই আমাদের অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যেতে যে পারবে - সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সকল সংস্কার এবং প্রস্তাবনার বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা প্রস্তুত? কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে কতটা বদ্ধপরিকর এবং অতীত রাজনৈতিক চর্চা আমাদের তেমন ইঙ্গিত দেয় কি? কিভাবে পরবর্তীতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার এই প্রস্তাবনা গুলোকে তার রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোর সাথে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা হাতে নেয়? – সেই বিষয়গুলোও গুরুত্বের সাথে জানা প্রয়োজন।

আশার কথা হল সংস্কার বিষয় এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন নেতিবাচক আলোচনা দেখা যাচ্ছে না। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক কর্মসূচি এবং কর্মকান্ড আমাদেরকে আশান্বিত হতে শেখায়। রাজনৈতিক দলগুলোর জনবন্ধু হয়ে ওঠার ভান না করে বরংচ গণমানুষের জন্য কিছু করবার এটাই যথাযথ সময়। দেশের অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার এখনই সময়। আমাদের দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল যদি তাদের অতীত কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাহলেই কেবল বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়া থেকে সুফল পাবে এবং আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংস্কার লক্ষ্যমাত্রা কেবলমাত্র কমিশন প্রণীত সুপারিশমালাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সত্যিকারের ভূমিকা পালন করবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিক সংলাপের ব্যবস্থা করা যাতে করে তাদের এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় যা তাদের অংশিদারীত্ব বৃদ্ধি করবে। এই প্রক্রিয়া সংস্কার বাস্তবায়নে ইতিবাচক ‍ভূমিকা পালন করবে বলে মনে হয়।

প্রতিহিংসার রাজনীতির ভুক্তভোগী হিসেবে সাধারণ মানুষ বরাবরই সামনের কাতারে থাকে। সেই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক দলগুলো সরে আসবে বলে আমার মনে হয়। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে আমরা সেটি দেখতে পাই। প্রতিহিংসার রাজনীতির জবাব রাজনৈতিক দলগুলো যেনো দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে দিতে পারে সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেন তৈরি হয়। সেই পরিবেশ ও দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলগুলো নিবে বলে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর যেহেতু সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ অনেক বেশি থাকে তাই তাদের কে জনপ্রিয় ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাস্তবসম্মত ও দৃশ্যমান কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে যা সাধারণ মানুষকে আশান্বিত করে যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার মূল্য সহনীয় ও নিয়ন্ত্রিত রাখা. জনগণের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এটি সমাজের প্রতিটা শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিদিনকার জীবন যাপনের উপর প্রভাব ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং জনগনের আস্থা ও ভরসার জায়গা তৈরি হবে। এই ভরসার জায়গা তৈরি করা অত্যাবশ্যক।

শ্বেতপত্রের প্রস্তাবনা গুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আমাদের সর্বপ্রথম জানতে হবে রাজনৈতিক বাyধাগুলো কি? কেননা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। এটি এইজন্যে বলা যে, স্বাধীন বাংলাদেশ কখনো একটি গণবান্ধব রাজনৈতিক ব্যবস্থা কিংবা এর কাছাকাছি একটি পরিস্থিতি গড়ে তোলার কাজ করেছে বলে দেখা যায়নি। এর পিছনে প্রধান কারণগুলো হলো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রের প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা, জনবন্ধব পলিসি প্রণয়ন থেকে দূরে থাকা, সর্বোপরি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে জনগণের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত রাখা। এমন একটি পরিস্থিতি যে আবারো তৈরি হবে না সে বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা অতীব জরুরী। রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই নিশ্চয়তা ও ভরসার জায়গা জনগণের সামনে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরতে হবে। দেশের উন্নয়নকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাyধাহীন করার লক্ষ্যে এই ঐক্য তখনই সহায়ক হবে যখন রাজনৈতিক পালাবদলের পরও উন্নয়ন কর্মকান্ড জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হবে। রাজনৈতিক প্রতিহংসার বশবর্তী হয়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উন্নয়ন আকাঙ্খা হিসেবে না দেখে জাতীয় আকাঙ্খা হিসেবে দেখে বাস্তবায়ন করার মত একটি জাতীয় মনোভাব গড়ে তুলতে হবে যেখানে দেশের স্বার্থ থাকবে সর্বাগ্রে।

পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে অর্থনৈতিক সংস্কার কেবলমাত্র একটি খাতের সংস্কার নয়। এই শ্বেতপত্রে যে সকল খাত গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সংস্কার অন্যান্য খাতের সাথে বিচ্ছিন্ন হিসেবে (অর্থাৎ আইসোলেটেড) বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতের সংস্কারের সাথে অর্থনৈতিক সংস্কারের সমন্বয় করবার জন্য একটি সমন্বিত অর্থাৎ ’হলিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি’ হাতে নিতে হবে। অর্থনৈতিক খাতের পাহাড়সম নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে সাথে দোষী ও দুর্নীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারিক ব্যবস্থায় নিয়ে আসার জন্য আমাদের তেমন একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থারও প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং সিন্ডিকেট ভাঙার জন্যও যথাযথ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার থাকার সাথে সদিচ্ছারও প্রয়োজন রয়েছে। এখানে আন্ত-মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

যদিও এই কমিশন এই অর্থনৈতিক স্থিরতার সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করার জন্য অপর একটি এডভাইসারি কাউন্সিল গঠন করার কথা বলেছেন যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে কে সহায়তা করবেন। তারপরও আমার মনে হয় প্রস্তাবিত সামগ্রিক সংস্কার কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে সে বিষয়ে আরো বিস্তারিত দিক নির্দেশনা থাকলে সরকারের জন্য সেগুলো বাস্তবায়ন করতে আরো সহায়তা করবে। সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পদক্ষেপ হাতে নেওয়া জরুরী। বিভিন্ন খাতের সংস্কার প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বাস্তবায়ন করার রূপরেখা হাতে নিলে নানাবিধ সংকীর্ণতা দেখা দিতে পারে। সেটি সঠিকভাবে কাজ না করার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। একটি পরিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট সময়কাল কেন্দ্রিক একটি দিক নির্দেশনা তৈরি করে একটি জাতীয় রোডম্যাপ ঘোষণা করা প্রয়োজন।

আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনই সময়। তাই ভেবে চিন্তে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। কেননা এমন সুযোগ বাংলাদেশের মানুষের জন্য বারবার আসবে না।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article