শ্রীমঙ্গলের পুতুলের বিশ্বজয়

4 hours ago 5
উঠানে গোল হয়ে বসে কাজ করছেন কয়েকজন নারী। কেউ সুতা বুনছেন, কেউ সেলাই করছেন, আর কেউ তৈরি পুতুলের মান পরীক্ষা করছেন। তাদের হাতের ব্যস্ততা আর মুখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রতিটি মুহূর্ত যেন পরিশ্রম আর সৃজনশীলতায় ভরপুর। চিত্রটি সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পাচাউন গ্রামের। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে কর্মক্ষম নারীরা যুক্ত হয়েছেন একটি বিশেষ উদ্যোগে, যা তাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। তারা তৈরি করছেন এক ধরনের বিশেষ পুতুল, যা একদিকে নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ এই পুতুলগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে। শিশুরা মুখে নিলেও কোনো ক্ষতি হয় না। এই গুণের জন্য বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এই পুতুল রপ্তানি হচ্ছে। নারীদের আত্মনির্ভরতার গল্প দক্ষিণ পাচাউন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নারীরা খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কেউ পুতুলের সেলাই করছেন, কেউ সুতো বুনছেন। কেউবা অবসরে নিজের তৈরি পণ্য নিয়ে গর্বিত আলোচনা করছেন। এই উদ্যোগ শুধু তাদের আয়ের পথই উন্মুক্ত করেনি, বরং তাদের জীবনে এনে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। জোবেদা নামের এক নারী বলেন, আমরা খুব যত্ন নিয়ে পুতুলগুলো তৈরি করি। কারণ জানি, এগুলো বিদেশে যাচ্ছে। এখান থেকে আয় হওয়ায় এখন সংসারের খরচে স্বামীকে সাহায্য করতে পারছি। আগে এই কাজ সম্পর্কে ধারণা ছিল না। এখন এটি করতে পারছি এবং উপভোগ করছি। শিক্ষার্থীদের নতুন সম্ভাবনা শুধু গৃহবধূ নয়, গ্রামের কলেজগামী মেয়েরাও এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে। সীমা নামের এক কলেজছাত্রী বলেন, আমি প্রতিদিন দুই ঘণ্টা এই কাজ করি। কলেজ শেষে সময় বের করে পুতুল বানাই। এখান থেকে আয় করা টাকায় নিজের বই, খাতা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে পারি। এখন আর পরিবারের কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয় না। আমাদের পণ্য যে বিদেশে যাচ্ছে, তা ভেবে খুব গর্ব হয়। প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছে ক্লাইমেট রেজিলিয়ান ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড লাইভলিহুডস (ক্রেল) এবং বুনন প্রশিক্ষণ সোসাইটির যৌথ প্রচেষ্টা। ক্রেল-এর কর্মকর্তারা জানান, গ্রামের নারীদের জন্য দুই মাসব্যাপী বিশেষ প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছিল। তাদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের সময় তারা ২০০-এর বেশি পুতুলের মডেল বানানোর কৌশল শিখেছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা এখন ঘরে বসেই প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা কাজ করছেন। তাদের তৈরি পুতুলের মধ্যে রয়েছে অক্টোপাস, কেটারপিলার, জিরাফ, পেঁচা ইত্যাদি। প্রতিটি পুতুলের জন্য ৩০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। ক্রেল কর্মকর্তারা আরও জানান, সেলাইয়ের সব উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। নারীরা যদি এভাবে কাজ চালিয়ে যান, ভবিষ্যতে তাদের মাসিক আয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় পৌঁছাতে পারে। পরিবর্তনের গল্প এই উদ্যোগের ফলে গ্রামের অনেক পরিবারের জীবন বদলে গেছে। রাহেলা নামের এক নারী বলেন, আমার স্বামী রিকশা চালান। তার আয়ে সংসার চলত না। এখন আমি পুতুল তৈরি করে আয় করি। এতে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। প্রথমে কাজটা করতে ভয় লাগত। মনে হত পারব না। কিন্তু প্রশিক্ষণের পর এখন আমি দ্রুত এবং ভালো মানের পুতুল তৈরি করতে পারি। আমাদের পণ্য বিদেশে যায়, এটা ভেবে খুব ভালো লাগে। শুধু রাহেলা নয়, তার মতো আরও অনেক নারী আজ সংসারে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। তারা এখন শুধু পরিবারের সদস্যই নন, বরং অর্থনীতির অংশীদার। বিশ্ববাজারে সাফল্য এই বিশেষ ধরনের পুতুলের চাহিদা বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে। কারণ এটি শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব। পুতুলগুলো মূলত কারুকার্যময় নকশা ও টেকসই উপকরণ দিয়ে তৈরি। এর ফলে গ্রামীণ নারীদের তৈরি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। শ্রীমঙ্গলের দক্ষিণ পাচাউন গ্রামের নারীদের পুতুল তৈরির উদ্যোগ শুধু তাদের জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনেনি, বরং তাদের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণ পেলে গ্রামের নারীরাও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এই উদ্যোগকে আরও সম্প্রসারণ এবং টেকসই করে তোলা গেলে, এটি শুধু স্থানীয় নারীদের জীবনমান উন্নত করবে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এটি নারী ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
Read Entire Article