ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানির পণ্য ব্যবস্থাপনা ধুঁকছে। বিমানবন্দরে কার্গো গুদাম সংকট। দক্ষ জনবলের অভাব। নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি। পণ্য খালাসে সরকারি নানা ধরনের নিয়ম-নীতিও বাধাগ্রস্ত করছে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া। লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা।
আকাশপথে আমদানি-রপ্তানির একটি বড় অংশ তৈরি পোশাক ও এর কাঁচামাল। এর বাইরে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং স্যাম্পল বা নমুনাপণ্য, চিকিৎসা, খাদ্যপণ্যও আমদানি করা হয়। এসব পণ্য আকাশপথে ক্রেতাদের সরবরাহ করেন ব্যবসায়ীরা, যাতে নির্দিষ্ট সময়ে বিদেশি ক্রেতার অর্ডার সরবরাহ করা যায়। কিন্তু বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা দূর করতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রতিদিন যে পরিমাণ পণ্য আকাশপথে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে, তার অর্ধেকও শাহজালাল বিমানবন্দরের গুদামে রাখার ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব পণ্য গুদামের বাইরে বে-এরিয়াসহ খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে কোন পণ্য কোন উড়োজাহাজে, কত তারিখে এসেছে তার সিরিয়াল থাকছে না। অনেক সময় পণ্য খুঁজে পেতে দিনের পর দিন সময় লাগছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা।
দিন যত যাচ্ছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইটও বাড়ছে। কিন্তু সে অনুপাতে বিমানবন্দরের ভেতরে কার্গো পণ্য রাখার সুযোগ কম। যে স্থাপনাগুলো আছে, সেগুলো অনেক পুরোনো। তবে তৃতীয় টার্মিনালে কার্গোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং আধুনিক সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে মূলত সময়মতো মানসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কারণে। কিন্তু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সীমাহীন জটিলতা ও অব্যবস্থাপনা এ খাতের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যাপ্ত কার্গো টার্মিনাল নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব প্রকট এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে রপ্তানিকারকদের প্রায়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পাঠাতে সমস্যায় পড়তে হয়।’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা সময়সীমা মেনে ডেলিভারির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। সেখানে একদিনের দেরিও পুরো চালান বাতিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে, যা দেশের ভাবমূর্তি ও রপ্তানি আয় উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব, কার্গো হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন, দক্ষ জনবল নিয়োগ, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা জরুরি। অন্যথায়, বৈদেশিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের এ দৈন্যের কথা স্বীকার করে বেবিচক। সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো গুদামের সংকট দীর্ঘদিনের। তৃতীয় টার্মিনালে নতুন অত্যাধুনিক গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে সেটা চালু হলে সংকট কেটে যাবে।
- আরও পড়ুন
দেশ থেকে কার্গো এয়ার শিপমেন্টে বড় বাধা ‘পরিবহন ব্যয়’
কার্গো স্পেসের সমাধান করলে ট্রান্সশিপমেন্ট সমস্যারও সমাধান হবে
চার্জ কমাতে কাজ করছে বিমান-বেবিচক, বাড়ছে দেশের সক্ষমতা
শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কার্গো পণ্যের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে বিমানের কোনো গাফিলতি নেই। ফ্লাইট অবতরণের পরপরই মালামাল নামিয়ে যথাস্থানে রাখা হয়। আবার যেসব পণ্য বিদেশে পাঠানো হবে, নির্ধারিত ফ্লাইটে তা উঠিয়ে দেওয়া হয়। আর বাকি যত কাজ কাস্টমসের।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার মান এমন পর্যায়ে নেমেছে যে আমদানিপণ্য আসার পর তা কবে খালাস হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে।- একটি বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবস্থাপক এনাম হোসেন
তিনি বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইটও বাড়ছে। কিন্তু সে অনুপাতে বিমানবন্দরের ভেতরে কার্গো পণ্য রাখার সুযোগ কম। যে স্থাপনাগুলো আছে, সেগুলো অনেক পুরোনো। তবে তৃতীয় টার্মিনালে কার্গোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং আধুনিক সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
আকাশপথে পণ্য আমদানির যত জটিলতা
ব্যবসায়ীরা জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো গুদামে পণ্যের জন্য মাত্র ১৭ হাজার বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এ জায়গায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে বিমান। তাদের দক্ষ জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। ফলে আমদানি পণ্য বিমানবন্দরে দিনের পর দিন আটকে থাকায় এবং খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে তাদের ব্যাপক লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এছাড়া আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন নিয়ম চালু করেছে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ম অনুযায়ী পণ্য চালান শুল্কায়নের ক্ষেত্রে সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও পারমিট ইত্যাদি বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডোর (ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো) সিস্টেমের মাধ্যমে দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসে বেগ পেতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কার্গো গুদামের ভেতর মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে পণ্য। এসব পণ্য রোদ-বৃষ্টিতে ভিজছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালে শাহজালাল বিমানবন্দর চালু হওয়ার পর অবকাঠামোগত বিশেষ পরিবর্তন কিছু হয়নি। প্রতিষ্ঠার সময় যে গুদাম করা হয়েছিল, এখনো সেগুলো দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। অথচ এখন প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫টি ফ্লাইট শিডিউল ও বিশেষ ফ্লাইটে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪শ টন বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। এ পণ্যের মধ্যে রয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসের পণ্য, বন্ডেড ওয়্যারহাউজের পণ্য (রপ্তানির জন্য যেসব পণ্য আমদানি করা হয়) এবং শুল্ক দিয়ে ছাড় করার পণ্য।
আকাশপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে একটি বিমানবন্দরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, শাহজালালে তা নেই। এর ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। যদিও শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে সব সুযোগ-সুবিধা রাখা আছে। এটি চালু হলে পণ্য বাণিজ্যে সমস্যা কমে আসবে।- ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ
শাহজালাল বিমানবন্দরে ৯ বছর ধরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করেন বিমানের কার্গো বিভাগের এক কর্মী। আলাপকালে তিনি বলেন, আগে বিমানবন্দরের বে-এরিয়ায় মালামাল রাখা হতো না। গত সাত-আট বছর ধরে সেখানে অনেক মালপত্র রাখা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জায়গার অভাব। যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হচ্ছে, সে অনুযায়ী ডেলিভারির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। এসব পণ্য দেখভালেও বিমানের দক্ষ জনবল সংকট রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের লোকসানসহ বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গত ২০ জুন বিমানবন্দরের কার্গো গুদাম থেকে পণ্য খালাস করে বের হচ্ছিলেন ঢাকার একটি বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবস্থাপক এনাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার মান এমন পর্যায়ে নেমেছে যে আমদানিপণ্য আসার পর তা কবে খালাস হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সেবাদানকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আকাশপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে একটি বিমানবন্দরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, শাহজালালে তা নেই। এর ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। যদিও শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে সব সুযোগ-সুবিধা রাখা আছে। এটি চালু হলে পণ্য বাণিজ্যে সমস্যা কমে আসবে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরে পণ্য আমদানির মতো রপ্তানিতেও নানান সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে রপ্তানির পিক সিজনে মালামাল রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে কয়েক মাস আগে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় শাহজালাল বিমানবন্দরে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে বিমান। চাপ কমাতে গত ২৭ এপ্রিল থেকে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর থেকে কার্গোপণ্য পরিবহন চালু করে বেবিচক। এছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাশাপাশি পোর্ট হ্যান্ডলিং চার্জ ও কার্গো পরিবহন ভাড়া কমাতে বেবিচক কাজ করছে বলে জানা যায়।
হিমায়িত খাদ্য আমদানি ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সাবেক সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, ‘এয়ার শিপমেন্টে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে নিজস্ব লজিস্টিক সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। সরকার চাইলে কম সময়ের মধ্যে এসব সুবিধা বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে কার্গো পরিবহনের জন্য। এয়ার কার্গো পরিবহন যাতে ব্যয়সাশ্রয়ী হয়, সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
জানতে চাইলে সাবেক বেবিচক চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় শাহজালাল বিমানবন্দরে পণ্যের চাপ বেড়েছে। তাই সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর থেকে কার্গোপণ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট চালুর প্রস্তুতি চলছে। এগুলো করা গেলে শাহজালালে চাপ থাকবে না। আবার শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে দেশের সব কার্গোপণ্য এখান থেকেই সরবরাহ করা যাবে।’
এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম