সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সঠিক পুষ্টি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের ধরন কেবল আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরই নয়, মানসিক অবস্থার ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করেছেন থাইরোকেয়ার বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট মুহাম্মাদ আরিফুল ইসলাম সজল। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মিরাজ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
মানুষ এখন ভারী খাবারের বিপরীতে নাস্তা খেয়ে কাটিয়ে দিতে চায়। ভাত না খেয়ে হাবিজাবি খায়। এই প্রবণতা মেয়েদের মধ্যে বেশি। দিনের প্রথম খাবারে প্রোটিন রাখা জরুরি এবং এটি অবশ্যই সকাল ৮টার মধ্যে শেষ করা।
জাগো নিউজ: যাদের পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণের সক্ষমতা নেই, তাদের জন্য প্রোটিনের বিকল্প কী?
মুহাম্মদ সজল: অ্যাসেনশিয়াল প্রোটিনের কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। আমরা ডাল গরিবের মাংস হিসেবে অনেক দিন ধরে প্রচার করেছি। মাংস, মাছ, মুরগি, ডিমের বিকল্প অন্য কিছু দিয়ে কাভার হয় না।
প্রথম পর্ব: পুরুষরাও এখন আয়রন ঘাটতিতে ভুগছে
জাগো নিউজ: দিনের প্রথম খাবার কীভাবে শুরু করা উচিত?
মুহাম্মদ সজল: মানুষ যদি দিনের প্রথম খাবারটা ঠিকমতো না নেয়, তখন সে সারাদিন এলোমেলোভাবে অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে থাকে। এটা দূর করা খুব কষ্টসাধ্য, কারণ আমাদের ব্রেন ওইভাবে সাজানো। দিনের প্রথম খাবারটা খুব ভালো হতে হবে। প্রথম খাবার সারাদিনের এনার্জি জোগায়। মানুষ এখন ভারী খাবারের বিপরীতে নাস্তা খেয়ে কাটিয়ে দিতে চায়। ভাত না খেয়ে হাবিজাবি খায়। এই প্রবণতা মেয়েদের মধ্যে বেশি। দিনের প্রথম খাবারে প্রোটিন রাখা জরুরি এবং এটি অবশ্যই সকাল ৮টার মধ্যে শেষ করা।
জাগো নিউজ: তরুণদের মধ্যে ডায়েটের প্রবণতা বেড়েছে। মানুষ ডায়েটে সাধারণত কী ভুল করে?
মুহাম্মদ সজল: ফুড কীভাবে বডি প্রসেস করবে সেটা অনেক মানুষ ভালো করে জানে না। এটার সঙ্গে ফিজিওলজি ও সাইকোলজি কানেক্ট, তবে এটা নিয়ে পুষ্টিবিদদের তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। মানুষ ফ্যাট বেশি খাবে নাকি কার্বোহাইড্রেট বেশি খাবে, এটা নিয়ে নিউট্রিশনে ডিবেট চলে। সবার জন্য ভালো, এমন ডায়েট পৃথিবীতে নেই। ব্যক্তির শরীর ও মন-মানসিকতা ভেদে ডায়েট ভিন্ন হয়। আমরা যদি ওজন কমাতে চাই কিছু জিনিস খাওয়া কমাতে হবে।
- আরও পড়ুন
কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজনের মানসিক সমস্যা
হার্টের রোগীর চাপ বাড়ছে ঢাকায়, বাড়ছে না চিকিৎসার পরিসর
‘ক্যানসার আক্রান্ত’ দেশের ক্যানসার চিকিৎসা
প্রথমে হলো রিফাইন কার্বোহাইড্রেট, যেমন সুগার, চাল, রুটি, পাউরুটি ইত্যাদি। এগুলো খাওয়া কমাতে হবে। কী পরিমাণ কমাতে হবে এটা নির্ভর করবে ব্যক্তির ওপর। অনেকে অনলাইন ভিডিও দেখে ডায়েট ফলো করে, কয়েকদিন ফ্যাট কমাতে পারলেও সেসব ফ্যাট আবার শরীরে আসে। যেসব নারীর গর্ভধারণের বয়স আছে, বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩৫ বয়সী নারীরা এই বয়সে মা হয়। ভেরি লো ক্যালরি ডায়েট নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
জাগো নিউজ: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কোন ডায়েট ক্ষতিকর?
মুহাম্মদ সজল: ডায়াবেটিস রোগীরা যদি হাই-কার্বোহাইড্রেট ডায়েট নেয়, এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। কারণ তাদের শরীরের কার্বোহাইড্রেটের লোড কমাতে হবে। তাকে যদি ৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট দেওয়া হয়, অনেক সময় দেখা যায় ফ্যাট আরও বেড়ে যাবে। লিভারেও ফ্যাট জমে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন যুক্ত হবে, ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করতে পারবে না। তাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কার্বোহাইড্রেট নেওয়া যাবে না।
হার্টের অসুস্থতা ও ফ্যাটি লিভারের রোগীদের বেলায় হাই-কার্বোহাইড্রেট খারাপ। যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তাদের জন্য আবার হাই প্রোটিন ডায়েট খারাপ। এর বাইরে যারা আছেন তাদের জন্য এসব ডায়েট খারাপ নাও হতে পারে।
হার্টের অসুস্থতা ও ফ্যাটি লিভারের রোগীদের বেলায় হাই-কার্বোহাইড্রেট খারাপ। যাদের কিডনির সমস্যা আছে, তাদের জন্য আবার হাই প্রোটিন ডায়েট খারাপ। এর বাইরে যারা আছেন তাদের জন্য এসব ডায়েট খারাপ নাও হতে পারে।
জাগো নিউজ: ওজন কমাতে গিয়ে মানুষ কী ধরনের ভুল করে?
প্রথমত মানুষ অতিরিক্ত কম খেয়ে শুরু করে। এতে তাদের মেটাবলিজম স্লো হয়ে যায়। মানুষ অতিরিক্ত ফ্যাট কাট করে। এতে বডি স্ট্রেসড আউট হয়, তখন বাড়তি সুগার নিতে ইচ্ছা করে। ডায়েটের ক্ষেত্রে অধিকাংশই মারাত্মক ভুল করে, এসব ডায়েটে থেকে হওয়া ক্ষতি এক বছরের আগে বোঝা যায় না। এতে শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। অনেকে ভুল ডায়েটের কারণে হতাশায় ভোগে। ডায়েট মানে কম খাওয়া না, ডায়েট হলো ব্যক্তির শরীর অনুযায়ী সব ধরনের ফুডের কম্বিনেশন করে পরিমিত আকারে খাওয়া। অনেক ব্যক্তি আছে, দিনে ৮০০ গ্রাম কার্বহাইড্রেট খেয়েও ওজন বাড়াতে পারছে না। অনেক আছে, বড় এক চামচের ভাত খেয়েও অনেক ওয়েট গেইন করে।
জাগো নিউজ: মানুষের অসুস্থতার জন্য খাদ্য কি অন্যতম কারণ?
মুহাম্মদ সজল: বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর ১০টি কারণের মাধ্যে সাতটি খাবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। খাবারের অভাবে যত মানুষ মারা যায়, এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় খাবারে অতিরিক্ত সুগার ও ফ্যাটের কারণে। এগুলোকে দূর করতে হলে শিক্ষায় যেতে হবে। ফুড প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশনে যদি পুষ্টিকর খাদ্যের কথা কিংবা হেলদি ফুড আসে তাহলে এগুলো অনেকটা ঠিক হয়ে যাবে। পুষ্টির সঠিক ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারলে রোগ-বালাই থেকে দূরে থাকা সম্ভব। নিউট্রিশনিস্টের কাছে গিয়ে এসব ঠিক করা যায় না। ততক্ষণে তো সমস্যা হয়েই যায়। আমি মনে করি মানুষের পুষ্টিবিদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে প্রতিটি সুস্থ মানুষের বছরে একবার পুষ্টিবিদের কাছ থেকে খাদ্যাভ্যাস ও খাবারের বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া যথেষ্ট।
জাগো নিউজ: বিভিন্ন মানুষের পুষ্টির চাহিদা কীভাবে আলাদা হয়?
মুহাম্মদ সজল: জেন্ডার ও বয়সভেদে মানুষের পুষ্টির চাহিদা বিভিন্ন ধরনের হয়। যখন একটা বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর হয়, তখন তার প্রচুর প্রোটিন ও ফ্যাট দরকার হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের ২৫ শতাংশ ফ্যাট হলেই হয়, কিন্ত বাচ্চার দরকার হয় ৪০ শতাংশ ফ্যাট। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পার কেজিতে ০ দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার হয়। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য দরকার ২ গ্রাম।
১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের জন্য কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন দুইটাই দরকার। মেয়েদের জন্য এসময় আয়রন ভিটামিন সি, জিংক, ভিটামিন ডি, ম্যাগনেশিয়াম এগুলো নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
শুধু মধু কিংবা বাদাম, অথবা চিয়াসিড খেয়ে মানুষ হেলদি লাইফ লিড করতে পারে না। হরমোনার ইন ব্যালেন্স, টেস্টোস্টেরন হরমোন কম থাকলে শুধু এসব খাবার খেয়ে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা কষ্ট। সুস্বাস্থ্যের জন্য মানুষের পুরো খাদ্যাভ্যাসটা জরুরি।
ছেলেদের জন্য জরুরি ভিটামিন ডি, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম। পুরুষদের জন্য দিনে ৮ মিলিগ্রাম আয়রন, নারীদের জন্য দিনে ১০ মিলিগ্রাম আয়রন এবং যারা গর্ভবতী তাদের জন্য ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন জরুরি। তবে মানুষের ওজন ও থাইরয়েড ভেদে এগুলো বদলায়।
জাগো নিউজ: তরুণসহ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে মধু, বাদাম, চিয়াসিড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটাকে কীভাবে দেখেন?
মুহাম্মদ সজল: শুধু মধু কিংবা বাদাম, অথবা চিয়াসিড খেয়ে মানুষ হেলদি লাইফ লিড করতে পারে না। হরমোনার ইন ব্যালেন্স, টেস্টোস্টেরন হরমোন কম থাকলে শুধু এসব খাবার খেয়ে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা কষ্ট। সুস্বাস্থ্যের জন্য মানুষের পুরো খাদ্যাভ্যাসটা জরুরি। ফুড কখনো মেডিসিনের মতো একা একা কাজ করে না। ফুড অনেকগুলো কম্বিনেশনের মাধ্যমে কাজ করে।
জাগো নিউজ: মানুষ চা-কফির প্রতি আসক্ত কেন?
মুহাম্মদ সজল: মানুষ চা পান করে সাধারণত অ্যাকটিভ হওয়ার জন্য। মানুষ অলসতা, বিরক্তিবোধ, চাপ কমাতে চা-কফি পান করে। তবে এসবের মূলে রয়েছে তরুণ সমাজের অনিয়মত ঘুম ও খাদ্যাভ্যাস। একজন মানুষ যখন রাত ২টায় ঘুমাতে যায়, পরদিন তার কাছে এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। পরবর্তীসময়ে তারা চা-কফির প্রতি নির্ভর হয়ে পড়ে। চা-কফি খেতে খেতে মানুষের শরীরে সুগার নেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়। যখন চা-কফি বারবার খাবে, তখন মিনারেল অ্যাবজর্ভ হয় না। মিনারেলের ঘাটতিতে ভোগে। সুগার ও লবণাক্ত খাবারের প্রতি মানুষের ঝোঁক থাকে বেশি। শিঙাড়া, সমুচা, ছোলা, বাদাম, টেস্টিং সল্ট দিয়ে খাচ্ছে। এগুলো খারাপ দিক।
এএএম/এএসএ/জেআইএম