সবুজের আঁচলে পাহাড়ি জীবনের ভরসা জুম চাষ

6 hours ago 5
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা ভাঁজে দাঁড়িয়ে দূর থেকে তাকালে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় সবুজের সমারোহ। কোথাও ধানের সবুজ গালিচা, কোথাও আবার কুমড়া লতা আর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভুট্টাগাছের নীলাভ ছায়া। বলছিলাম খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার পাহাড়িদের ঐতিহ্য জুম চাষের কথা। চিরসবুজ এ জনপদে জুম চাষ শুধু কৃষিকাজ নয়; বরং পাহাড়ি জীবনধারার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে জুম চাষের মাধ্যমে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তারা পাহাড়ের আগাছা পরিষ্কার করে আগুনে পোড়ায়। এরপর বৃষ্টির পানিকে ভরসা করে একই জমিতে ধান, ভুট্টা, কুমড়া, তিল, মরিচসহ নানান শস্য ফলিয়ে তোলে। এক জমিতে একসঙ্গে নানা ফসলের চাষ এটাই জুমের বৈশিষ্ট্য। সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, সবজি চাষ ও ফলদ বাগান স্থাপনে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা না বাড়ালে পাহাড়ি পরিবারগুলোর জন্য জুমের বিকল্প গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।  সরেজমিন দেখা গেছে, মাটিরাঙ্গা সদরের অদূরে অযোদ্ধা এলাকায় মূল সড়ক থেকে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পথ পাড়ি দিলে চোখে পড়বে একটি বিশাল টিলা ভূমি। নিরিবিলি পরিবেশে পায়ে হেঁটে টিলার কাছে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা দারুণ। ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে উঠতে শরীরের প্রায় সমস্ত শক্তি ক্ষয়ে যায়। মনে হয় একটু জিরিয়ে না নিলে আর এগোনো সম্ভব নয়। টিলা উঠার প্রতিটি ধাপে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এমনভাবে চোখে ভেসে ওঠে যে, ক্লান্তির ভার যেন আর টেরই পাওয়া যায় না। সবুজ গাছপালা, টিলা ঘেরা নিস্তব্ধতা আর শীতল হাওয়ার ছোঁয়া পথিককে এক অনন্য অভিজ্ঞতা উপহার দেয়। টিলার চূড়ায় উঠেই হাতের বাঁপাশে মাটিরাঙ্গা ধলীয়া মৌজা নামক স্থানে দেখা মিলবে ধান, ভুট্টা, কুমড়া বিভিন্ন প্রজাতির সবজিসহ দৃষ্টিনন্দন একটি জুম ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝামাঝি জায়গায় ছন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি দুটি ঝুপড়ি ঘর দাঁড়িয়ে আছে সাদামাটাভাবে। তবে এ সরল নির্মাণশৈলী যেন ক্লান্ত পথিক বা জুমিয়াদের জন্য স্বস্তির আশ্রয় যে কেউ সেখানে কয়েক মিনিট বসলে শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিশ্চিতভাবেই। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছড়ায় চারপাশের দৃশ্য। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাহাড়ের ভাঁজে সবুজ ধানক্ষেত, বাহারি সবজির সমাহার আর পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে জুম ক্ষেতটি হয়ে ওঠে বড়ই চমৎকার। চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে ওঠে প্রকৃতির মায়াবী টানে। জুমের জমি প্রস্তুত থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে থাকে এক ধরনের উৎসবের আমেজ। পাহাড়ি পরিবারগুলো দল বেঁধে কাজ করে। কেউ গাছ কাটে, কেউ আগুন জ্বালায়, আবার কেউ বীজ ছিটায়। এ মিলিত প্রচেষ্টা তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে জুম চাষ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। পরিবেশবিদদের মতে, লাগাতার জুম চাষের ফলে বন উজাড় হচ্ছে, পাহাড়ের মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের হুমকির মুখে পড়ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে পুরো পরিবেশ ব্যবস্থায়।  চাষিরা জানান, দীর্ঘবছর ধরে বংশপরম্পরায় অনেকেই জুম চাষ করে আসছে। বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় পাহাড়িরা বাধ্য হয়েই জুমের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় চাষি সুনি ত্রিপুরা বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে বাবাদের সঙ্গে জুম চাষ করে আসছি। জুম চাষটি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। একই জমিতে ধান, মরিচ, কুমড়া, মারফাসহ সব একসঙ্গে হয়। বাজার থেকে কিনে আনতে হয় না, পরিবারের সবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে পড়াশোনাসহ ভরণপোষণের জোগান হয়। স্থানীয় কৃষক আকবর হোসেন বলেন, আমি ৩ বিঘা জমিতে জুম চাষ করি। জুম ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। জমিও নেই তেমন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা শুনেছি কিন্তু সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কৃষি অফিস যদি চাহিদা মোতাবেক উন্নত বীজ, সার আর বাজারের সুবিধা দেয়, তাহলে আমরাও কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করে পাহাড়ে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারব। স্থানীয় আরেক কৃষক অগ্য মারমা বলেন, জুম চাষ আমাদের পূর্বপুরুষদের ধারা। জুম চাষ যদিও  শ্রমসাধ্য, তবুও এটাই আমাদের একমাত্র ভরসা। আধুনিক সরঞ্জাম ও ঋণ সুবিধা পেলে আমরা আরও ভালোভাবে ফসল উৎপাদন করতে পারব। মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী বলেন, জুম চাষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি হলেও বন ও জমি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। আমরা কৃষকদের টেকসই জুম চাষে উৎসাহিত করছি এবং বিকল্প আয়ের উৎস যেমন ফলদ বাগান, সবজি চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সঠিক পরিকল্পনা ও যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি সহায়তা পেলে জুম চাষীরা শুধু নিজেদের জীবিকা নয়, স্থানীয় অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে।
Read Entire Article