সরকারি খরচে ৬৫ বার বিদেশ গেছেন এমডি জাহেদুল
সরকারি খরচে ৬৫ বার বিদেশ সফরে গেছেন রূপপুরসহ দেশের সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) এমডি জাহেদুল হাছান। শুধু বিদেশ সফরই নয়, নিয়োগ বাণিজ্য ঘিরে কিছু কর্মকর্তাকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতারা হলেন—এনপিসিবিএলের বর্তমান এমডি জাহেদুল হাছান, রূপপুরের প্রকল্প পরিচালক কবীর হোসেন, অলোক ভট্টাচার্য, মুশফিকা আহমেদ, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা খালেদ মাহমুদ খানসহ কয়েকজন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তারা এতটাই ক্ষমতাধর যে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নকারী রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান রোসাটমের পরামর্শ কিংবা মতামতও পাত্তা দেন না তারা। একটি পদে প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে রোসাটম প্রশ্ন তোলার পরও সিন্ডিকেটের আগ্রহের কারণে সেই নিয়োগ আটকানো যায়নি। বরং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুললে চাকরিচ্যুত হতে হয়। তাদের ক্ষমতার দাপটে এক দিনের মধ্যে ১৮৬ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ১৮ জনকে; যারা রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়া থেকে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন।
সূত্র জানায়, দৌরাত্ম্য এখানেই থেমে নেই—এনপিসিবিএলের এমডি ড. জাহেদুল হাছান সরকারি খরচে গত এক যুগে অন্তত ৬৫ বার বিদেশ সফর করেছেন। রাশিয়ায় নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা থাকার পরও হোটেল ভাড়া দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগও আছে জাহেদুলের বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) যাওয়ার পরও বিধি ভেঙে জাহেদুলকেই এমডি পদে বহাল রাখা হয়েছে।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। এজন্য রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চুক্তির অধীনে ১ হাজার ৪২৪ জনকে বিভিন্ন ধাপে রাশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণে পাঠানোর কথা। শুরুতে রূপপুরে রাশিয়ার দক্ষ কর্মীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশিরা কাজ করবেন। রাশিয়ার কর্মীরা ফিরে যাওয়ার পর প্রক্ষিণপ্রাপ্ত বাংলাদেশিরা রূপপুর প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন—এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তির শর্তে।
চুক্তি অনুযায়ী, ১৪২৪ জনের মধ্যে ৩০৫ জনকে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়েছে। রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন ৯৮৫ জন, তাদের মধ্যে ১৪ জন এখনো প্রশিক্ষণরত। বাকি ৯৭১ জন নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এ ছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রূপপুর এনপিপি ট্রেনিং সেন্টারে জেনারেল কন্ট্রাক্টের আওতায় ২৯৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আটজন এখনো প্রশিক্ষণরত। বাকি ২৮৯ জন প্রশিক্ষণসম্পন্ন করে প্রকল্পের কাজে যোগ দিয়েছেন। বাদ পড়েছেন ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাদ পড়েছেন ১৮ জন এবং আরও ১৪২ জনকে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পর রাশিয়ার কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে যেভাবে বাংলাদেশি কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর কথা ছিল, তা পুরোপুরি হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী শুরুতে ৯০ শতাংশ কাজ রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের করার কথা, বাকি ১০ শতাংশ করবে বাংলাদেশ। তা না করে শতভাগ কাজই চলছে রাশিয়ার কর্মীদের মাধ্যমে। ফলে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেও হাতে-কলমে কাজ করে ব্যবহারিকভাবে দক্ষ হতে পারছেন না বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে রাষ্ট্রের কী ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবছেন না তারা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হলেন রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক এনপিসিবিএলের এমডি জাহেদুল হাছান। নিজের আধিপত্য ধরে রাখার পাশাপাশি কেউ যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য একাই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ কবজায় রেখেছেন তিনি। সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ যেন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আসতে না পারেন, সেজন্য সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের আগে থেকেই বদলি কিংবা কোণঠাসা করে রেখেছেন জাহেদুল। এসব কাজে বেপরোয়াভাবে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতেও পিছপা হননি তিনি। মতের পার্থক্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলে যে কাউকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ধরিয়ে দেন তিনি। তার রোষানলে পড়ে হয়রানির শিকার কিংবা চাকরিচ্যুত হয়েছেন বহু কর্মকর্তা। দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিয়ে রূপপুর প্রকল্পে অনেকেই কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না জাহেদুলের আস্থাভাজন না হওয়ায়। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। তাই রাষ্ট্রের টাকায় প্রশিক্ষণ পেয়েও কর্মহীন অলস সময় কাটছে তাদের।