• সাগরে মাছ কমেছে, মিলছে না মাছ ধরা বন্ধের সুফল
• সরকারি মানবিক সহায়তা নিয়েও নয়-ছয়
একেকজন জেলে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করছেন ২০ থেকে ৪০ বছর ধরে। কারও সংসারে আসেনি সচ্ছলতা। জীবনের এ বেলায় এসে পেশা পাল্টানোর সুযোগও নেই অনেকের। তবুও সাগরে মাছ শিকার তাদের পেশা ও ভালোবাসা।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বঙ্গোপসাগর উপকূলের জেলেদের জীবন চলছে এভাবেই। গত কয়েক বছর ধরে সাগরে তেমন মাছ পড়ছে না। বিশেষ করে ইলিশ মাছ। প্রজনন মৌসুমে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ রাখার সুফলও মিলছে না। বরং মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে মানবিক সহায়তার সরকারি বরাদ্দের চালও ঠিকমতো পান না বলে অভিযোগ জেলেদের।
আনোয়ারার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পরুয়া পাড়া গ্রামের সাগর পাড়ে ছিঁড়ে যাওয়া জাল মেরামত করছেন শহীদুল আলম। এখন সাগর উত্তাল। নৌকা ভাসানোর সুযোগ নেই। এই সময়ে ছিঁড়ে যাওয়া জাল মেরামত করছেন। শহীদুল বলেন, ‘২৫ বছর ধরে সাগরে যাই। গত তিন-চার বছর ধরে সাগরে তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন সাগরে মাছ নেই বললেই চলে।’
একই গ্রামের ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘আনোয়ারা উপকূলে প্রচুর জেলে রয়েছে। গত চার বছর ধরে সাগরে তেমন মাছ নেই। লোকসান দিতে দিতে অসহায় পড়েছি। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আত্মীয়-স্বজনরা কথা বলতে চাইছে না, পাওনাদাররা ধার দিচ্ছে না, সুদেও মিলছে না ঋণ।’
চার কন্যা সন্তানের জনক মো. সোলায়মানও ২৫ বছর ধরে সাগরে যান। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েরা লেখাপড়া করে। সাগরে গিয়ে সংসারে সচ্ছলতা আসেনি। আমাদের দক্ষিণ পরুয়া, উত্তর পরুয়া প্রত্যেক ঘরের বেশিরভাগ পুরুষ সাগরে যায়। এখন সাগরে মাছ না পড়ায় সবাই টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। সরকারি সহায়তাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
৬৫ বছর বয়সী আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি ১০ বছর লিবিয়ায় ছিলাম। দেশে এসে টং জাল কিনেছি। গত ১৫ বছর ধরে সাগরে মাছ শিকার করি। এবছর কোনো মাছই পাইনি। জাল বসাইছি, মাছ পাইনি। অনেক টাকা লোকসান দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
জেলে নুরুচ্ছফা বলেন, ‘গত বন্ধের সময়ে আমাদের একবার ১৫ কেজি আরেকবার ৬-৭ কেজি চাল দিয়েছে। জেলেদের নামে চাল আরও বেশি আসে। মেম্বার-চেয়ারম্যানরা ভোটের জন্য একজনের চাল অন্যজনকে ভাগ করে দেয়।’
আরও পড়ুন
- সাগরে বেশি ধরা পড়ছে ছোট ইলিশ
- অর্জিত হয়নি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সক্ষমতা
- ভরা মৌসুমে সাগর মোহনায় ডাকাত আতঙ্ক, মাছ শিকারে লাগে বিশেষ টোকেন
- গভীর সাগরে মাছ ধরায় গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর বলছে, আগে বছরের মে ও জুলাই মিলে ৬৫ দিন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হতো। চলতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মূলত আগে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সঠিক সমন্বয় ছিল না। স্থানীয় নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারত-মিয়ানমারের জেলেরা সাগরে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। এতে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছ আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে একটি ইলিশ বছরে ছয়বার পর্যন্ত ডিম দেয়। আর একটি ইলিশকে জীবনে একবার হলেও ডিম দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যেটা আমাদের দেশে কার্যকর করা যাচ্ছে না।- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল আলম শাহীন
উপকূলীয় এলাকার জেলেরা বলছেন, চলতি বছর নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাগরে মাছ শিকার বিলম্বিত হয়েছে। জুলাই মাসের শেষ দিকেও সাগর উত্তাল ছিল।
সাগরে যে কারণে মাছ কম
সাগরে অনিয়ন্ত্রিত মাছ শিকার ইলিশ কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল আলম শাহীন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘উন্নত দেশে প্রতি বছর সাগর থেকে পরিকল্পনামাফিক মাছ আহরণ করা হয়। আমাদের দেশে সেটা হয় না। সাগর থেকে বছরে কী পরিমাণ মাছ আহরণ করা হয় তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। বিশেষ করে কয়েক বছর আগে বঙ্গোপসাগর থেকে বড় বড় ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল। এটা আমাদের শুনতে সুখের মনে হলেও সাগরে মাছের প্রজননের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে।’
‘আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এ কারণেও সাগরে ইলিশ কমে গেছে। এসব বয়স্ক ও বড় আকৃতির মাছ অধিক ডিম দেয়। এসব মাছ সংরক্ষণ করা গেলে সাগরে ইলিশের কমতি হতো না।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে একটি ইলিশ বছরে ছয়বার পর্যন্ত ডিম দেয়। আর একটি ইলিশকে জীবনে একবার হলেও ডিম দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যেটা আমাদের দেশে কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমাদের হাট-বাজারে যততত্র জাটকা পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাছ শিকার একেবারে বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারি কঠোর সিদ্ধান্তের প্রয়োজন।’
এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, ‘সাগরে সক্রিয় ফিশিং গিয়ার (ফিশিং ভ্যাসেল) ব্যবহার হচ্ছে, তাও সঠিকভাবে জানা নেই। সাগরে গিয়ারপ্রতি মাছ আহরণ সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ইলিশ মাছের টেকসই ব্যবস্থাপনায় একটি সুসংহত ও বৈজ্ঞানিক কাঠামো গড়ে তোলা গেলে আবার সাগরে পর্যাপ্ত ইলিশ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।’
আনোয়ারায় ৭৪৩১ জন নিবন্ধিত জেলে আছেন। অনিবন্ধিত জেলের সংখ্যা আমাদের জানা নেই। বরাদ্দ অনুযায়ী চাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দিয়ে দেওয়া হয়। বরাদ্দের চেয়ে চাল কম পাওয়ার কথা নয়।-আনোয়ারা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. রাশিদুল হক
মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় মেলে না পর্যাপ্ত সহায়তা
সরকারি সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালে সাগরে ৫৮ দিন মাছ শিকার বন্ধের সময়ে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত জেলেপ্রতি ৭৮ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি বছর সাগরে ৫৮ দিনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলার জন্য দুই কিস্তিতে ২৭ হাজার ২৩ জন জেলের বিপরীতে সর্বমোট ১৯১৮ মেট্রিক টন ৩৫৬ কেজি ভিজিএফ চাল বরাদ্দ পাওয়া যায়।’
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত জেলেপ্রতি ৭০ কেজি ৯৮৯ গ্রাম করে চাল পাওয়ার কথা। কিন্তু উপকূলের জেলেরা দুই কিস্তিতে সাকুল্যে ২৫ কেজি চালও পাননি। তাছাড়া নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত জেলের সংখ্যা এবং চাল বরাদ্দ নিয়ে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বক্তব্যে।
দক্ষিণ পরুয়া পাড়া গ্রামটি আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। ওই গ্রামের জেলেদের বক্তব্য মিলে যায় ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রফিকুল ইসলামের বক্তব্যের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শেষ বার জেলেপ্রতি ৮ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এর আগের বার খুব সম্ভব ১৭ কেজি করে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক মনে নেই।’
জেলেদের মানবিক সহায়তার চাল কম পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে আমরা জেলেদের কাছ চাল পৌঁছে দিয়েছি।’
আনোয়ারা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. রাশিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আনোয়ারায় ৭৪৩১ জন নিবন্ধিত জেলে আছেন। অনিবন্ধিত জেলের সংখ্যা আমাদের জানা নেই। বরাদ্দ অনুযায়ী চাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দিয়ে দেওয়া হয়। বরাদ্দের চেয়ে চাল কম পাওয়ার কথা নয়।’
উপজেলা পর্যায়ে জেলেদের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে। আনোয়ারা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বেগম উমা খান কাফি জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৪৮০ পরিবারে মাসে ৪০ কেজি করে দুই মাসের জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
নিবন্ধনের বাইরেও অনেক জেলে পরিবার রয়েছে। সে কারণে অনেক আগে থেকে উপকূলের জেলেরা নিজেরাই বরাদ্দের চাল সব জেলে পরিবারে ভাগ করে নেওয়ার একটি নিয়ম প্রচলিত আছে। এতে জনপ্রতি হিসেবে জেলেরা কিছু চাল কম পায়, সেটি সত্য।- আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলেদের ভিজিএফ কর্মসূচির চাল বিতরণ নিয়ে কোনো অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয়নি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চাল পরিবহনের খরচ জেলেদের কাছ থেকে না নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে আনোয়ারায় নিবন্ধিত যত জেলে রয়েছে, সরকারিভাবে তত পরিমাণ চাল বরাদ্দ পাওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আবার নিবন্ধনের বাইরেও অনেক জেলে পরিবার রয়েছে। সে কারণে অনেক আগে থেকে উপকূলের জেলেরা নিজেরাই বরাদ্দের চাল সব জেলে পরিবারে ভাগ করে নেওয়ার একটি নিয়ম প্রচলিত আছে। এতে জনপ্রতি হিসেবে জেলেরা কিছু চাল কম পায়, সেটি সত্য। তবে কোনো অনিয়ম হয়নি।’
অনিবন্ধিত জেলেদের কেন নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়মিতভাবে জেলে নিবন্ধন হচ্ছে। তবে এখন থেকে সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া সব জেলেদের নিবন্ধনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস