জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনড় অবস্থানে রয়েছে। এর আগে এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিলের আন্দোলন দমাতে সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
বুধবার (২৫ জুন) সকাল থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও কলমবিরতি পালন করে ঐক্য পরিষদ। সকাল থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনের সামনে অবস্থান নেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এবং মহাসচিব অতিরিক্ত কর কমিশনার মিজ সেহেলা সিদ্দিকা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। তারা বলেন, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সরকার এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্তে এখনো অটল। যা সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।
গতকাল মঙ্গলবার একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার ও আজ সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনবিআরের সাম্প্রতিক আন্দোলনে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীদের ইন্ধন রয়েছে। পাশাপাশি এনবিআর বিলুপ্ত করে পৃথক বিভাগ করার কথাও তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন।
- আরও পড়ুন
- এনবিআরে আন্দোলনের পেছনে ‘ব্যবসায়ীদের’ ইন্ধন: অর্থ উপদেষ্টা
- রাজস্ব ফাঁকি: এনবিআরের ৯ মাসে আদায় ৯৯৪ কোটি টাকা
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদ জানায়, অর্থ উপদেষ্টার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার সূত্রে আমরা জানতে পারি যে তিনি বলেছেন, এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ গঠন করা হবে। অর্থাৎ, এটি সরকারের বিগত ২৫ মে জারিকৃত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
গত ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করা হবে।
বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো কীভাবে প্রণীত হবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটি ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথকীকরণের লক্ষ্যে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সব সংশোধনী আনা হবে। এর আগ পর্যন্ত জারিকৃত অধ্যাদেশটি কার্যকর করা হবে না।
২৫ মের আগে এনবিআর বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রায় এক সপ্তাহ কলমবিরতির কর্মসূচি পালন করেন এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আজ সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদ জানায়, ২৫ মের বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ একই দিনে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।
এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি তুলে বলা হয়, ঐক্য পরিষদ কর্তৃক ‘কেমন এনবিআর চাই’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক সভা আয়োজনে বাধা দিচ্ছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। ঐক্য পরিষদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, শাস্তি ও বদলির হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তিনি (অর্থ উপদেষ্টা) সাক্ষাৎকারে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা পৃথক করা হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি যে, রাজস্ব নীতি পৃথককরণ আমরাও চাই, এ ব্যাপারে আমাদেরও কোনো ছাড় নেই। রাজস্ব সংস্কারে আইনগত বিষয়সহ রাজস্ব ব্যবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার আমরা দৃঢ়ভাবে চাই।
এনবিআরের ভেতর থেকেও কেউ কেউ সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন বলে উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কতটুকু সত্য তা সময়ই বলে দেবে।
চলমান আন্দোলনে ব্যবসায়ীদের ইন্ধন রয়েছে- উপদেষ্টার এ বক্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়, কে বা কারা এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তা তদন্ত করে সরকার দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করুক। এটা আমাদের দাবি। আমরা আগেও বলেছি, দেশবাসীও দেখেছে যে, আমাদের কর্মসূচি ছিল একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত ও টেকসই সংস্কারের তাগিদে। এনবিআরের ইতিহাসে এই প্রথম ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে এত দীর্ঘদিনের ও এত বড় কর্মসূচির পেছনে কোনো গোষ্ঠীর ইন্ধন খোঁজার প্রয়াস মাঠপর্যায়ের প্রকৃত তথ্য না পাওয়ার কারণেই ঘটেছে বলে আমাদের মনে হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, অর্থ উপদেষ্টা আগামীকাল (২৬ জুন) বিকেল ৫টায় বিসিএস (কর) ও সিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের প্রতিনিধিদের তার সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা বরাবরই আলোচনার পক্ষে। আর আলোচনার পক্ষে ছিলাম বলেই ২০ মে উনার সঙ্গে
আলোচনায় অংশগ্রহণ করি। তবে ওই আলোচনার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না।
তারা বলেন, এ অবস্থায় আগামীকালের আলোচনার প্রস্তাবের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো- যেহেতু সরকার ২৫ মে জারিকৃত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিলুপ্ত না করে বরং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করার অবস্থান থেকে সরে এসেছে এবং যেহেতু এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদের ২৬ জুন অনুষ্ঠিতব্য আলোচনার জন্য আহ্বান করেননি, ফলে কর্মসূচি পালনকারী এনবিআর ঐক্য পরিষদ থেকে কোনো প্রতিনিধি ওই আলোচনায় অংশ নেবে না।
এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামীকাল ২৬ জুন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কলমবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও রপ্তানি ব্যতীত ট্যাক্স এই কর্মসূচির বাইরে থাকবে। আগামী ২৭ জুনের মধ্যে অপসারণ না করা হলে আগামী ২৮ জুন থেকে ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন চলবে।
তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কমপ্লিট শাটডাউনের আওতাবহির্ভূত থাকবে। আগামী ২৮ জুন থেকে সারাদেশের ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তর থেকে এনবিআর অভিমুখে ‘মার্চ টু এনবিআর’ পালিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার সানুগ্রহ হস্তক্ষেপ ছাড়া এ অচলাবস্থার নিরসন হবে না মর্মে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মনে করে।
এসএম/এমকেআর/জিকেএস