সুন্দরবনে বিষ চক্রের নতুন ফাঁদ শামুক পাচার

1 day ago 4

* জলাশয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী শামুক
* নদীর তলদেশ খনন করায় নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য
* নির্বিচারে শামুক নিধনে ভেঙে যাবে জলাশয়ের খাদ্যচক্র

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নতুন কৌশল হিসেবে শামুক নিধন ও পাচার শুরু করেছে একটি অসাধু চক্র। বন সংলগ্ন নদী-খাল থেকে প্রতিদিন ভোর কিংবা গভীর রাতে ট্রলার ও নৌকায় ভরে নির্বিচারে শামুক সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরে এসব শামুক ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অর্থের লোভ দেখিয়ে এই কাজে জড়ানো হচ্ছে প্রান্তিক জেলেদের। এভাবে কয়েকশো মণ শামুক একদিনেই সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সুন্দরবনে বিষ চক্রের নতুন ফাঁদ শামুক পাচার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শামুক হচ্ছে জলাশয়ের স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এটি নদী-খালের তলদেশে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে পানির গুণগত মান ঠিক রাখে। কিন্তু নির্বিচারে শামুক নিধন করলে শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট হবে না, বরং জলজ প্রাণীদের খাদ্যচক্রেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।

‘নদীর পানিতে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে মাছ ধরার প্রবণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে ছোট মাছ, চিংড়ির রেণু, কাঁকড়া এবং শামুক একসঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে। এটি শুধু জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুতেও প্রভাব ফেলবে।’

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এ পাচারচক্র শুধু শামুকই নয়, চিংড়ি আহরণের সময় বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করছে। মাছের ঝাঁক সহজে ধরতে নদী-খালের পানিতে মেশানো হচ্ছে কীটনাশক জাতীয় রাসায়নিক। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোট মাছ, চিংড়ির রেণু, কাঁকড়া, কই, টেংরা থেকে শুরু করে অন্যান্য জলজ প্রাণী অচেতন হয়ে ভেসে ওঠে। জেলেরা তখন জাল দিয়ে সহজেই সেগুলো ধরে ফেলে। কিন্তু এর ফলে নদীর বাস্তুসংস্থান ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পরিবেশবিদদের মতে, এসব রাসায়নিক পদার্থ শুধু মাছ বা রেণুকেই মারে না, পানির ভেতর থাকা অণুজীব, শৈবাল ও পলি জমাকেও ধ্বংস করে দেয়। ধীরে ধীরে নদীর তলদেশ শক্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে, জৈব উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এক সময় সেই নদী আর জীববৈচিত্র্য ধারণ করতে সক্ষম হয় না। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে সুন্দরবনের ভেতরের খাদ্যচক্র ও বন্যপ্রাণীর ওপরও।

সুন্দরবনে বিষ চক্রের নতুন ফাঁদ শামুক পাচার

স্থানীয়রা বলছেন, নদী-খালে শামুক কুড়াতে গিয়ে তলদেশ খনন করার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর সংখ্যাও কমছে। সুন্দরবনের যেসব নদী ও খাল এতদিন স্থানীয় জেলেদের জীবিকার উৎস ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে নিঃশেষ হওয়ার পথে।

‘শামুক নিধন ও পাচার নজরে রয়েছে এবং বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান চলছে। মাঝে মাঝে বিপুল শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হচ্ছে, পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’

সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ এলাকার জেলে খানজাহান বলেন, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কিছু জেলেকে কাজে লাগাচ্ছে। প্রতিদিন নদী-খাল থেকে শামুক কুড়িয়ে ট্রাকে ভরে পাচার করছে। অথচ আমরা নদী রক্ষায় তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ রাখি, কিন্তু শামুক নিধনের কারণে আমাদের সব পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, শামুক শুধু জলাশয়ের পানির গুণগত মান বজায় রাখে না, বরং মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য হিসেবেও অপরিহার্য। নির্বিচারে শামুক নিধনের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং জেলেদের জীবিকা উভয়ই হুমকির মুখে পড়ছে।

সুন্দরবনে বিষ চক্রের নতুন ফাঁদ শামুক পাচার

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. অলিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শামুক তলদেশের জৈব পদার্থ খেয়ে পানিকে পরিশুদ্ধ রাখে। একইসঙ্গে মাছ, কাঁকড়া ও অনেক জলজ প্রাণীর জন্য এটি প্রধান খাদ্য। কিন্তু নির্বিচারে শামুক নিধন করলে খাদ্যচক্র ভেঙে যাবে, ফলে নদী-খাল উজাড় হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, নদীর পানিতে বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে মাছ ধরার প্রবণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে ছোট মাছ, চিংড়ির রেণু, কাঁকড়া এবং শামুক একসঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে। এটি শুধু জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুতেও প্রভাব ফেলবে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়বে, জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হলে কার্বন শোষণের ক্ষমতাও কমে যাবে। তাই এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ ভয়াবহ সংকটে পড়বে।

‘সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি পানির দূষণ কমাতে সহায়তা করে এবং মাছ ও কাঁকড়ার জন্য প্রধান খাদ্য।’

স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিওর পরিচালক আল ইমরান এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি পানির দূষণ কমাতে সহায়তা করে এবং মাছ ও কাঁকড়ার জন্য প্রধান খাদ্য। শামুক নিধন চলতে থাকলে শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তাই এখনই এ অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের স্মার্ট টহল টিমসহ কয়েকটি দল সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। অবৈধ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জব্দ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, গত কয়েক মাস ধরে শামুক পাচারচক্রের এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সম্প্রতি আমাদের একটি বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। শুধু বনাঞ্চলের ভেতরে নয়, পাশের লোকালয়েও পাচারচক্রের সক্রিয়তা রয়েছে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

পশ্চিম সুন্দরবনের সহকারী বন সংরক্ষক ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, শামুক নিধন ও পাচার নজরে রয়েছে এবং বন বিভাগের নিয়মিত অভিযান চলছে। মাঝে মাঝে বিপুল শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হচ্ছে, পাশাপাশি টহল জোরদার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু শামুক নয়, বিভিন্ন অসাধু চক্র মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ সম্পদও অবৈধভাবে আহরণ করছে। এসব প্রতিরোধে টহল দল প্রতিদিন নদী-খালে নজরদারি করছে। মামলা করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।

ফজলুল হক আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় জনগণ, বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সমন্বয় অপরিহার্য। তা না হলে অবৈধ কর্মকাণ্ড জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক নিধন ও পাচার বন্ধ করতে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে বন ও পরিবেশ আইনে দ্রুত মামলা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নদী-খাল ও বন সংলগ্ন এলাকায় স্মার্ট টহল জোরদার, প্রকৃত ব্যবসায়ী ও অর্থদাতাদের শনাক্ত, স্থানীয় জেলেদের সচেতন করা, দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শামুক নিধনের পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং কিছু অংশ ‘শামুক সংরক্ষণ এলাকা’ ঘোষণা করে সম্পূর্ণ নিধন নিষিদ্ধ করা।

এফএ/জেআইএম

Read Entire Article