সেনাবাহিনীকে নয়, অপরাধীকে দায়ী করুন
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক সংগঠন নয়; এটি জাতির অস্তিত্ব, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। স্বাধীনতার রক্তাক্ত সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া এই বাহিনী আজ দেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ, জাতীয় ঐক্যের প্রতিচ্ছবি এবং বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের গর্বের পতাকা বহনকারী শক্তি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক দল তরুণ মুক্তিকামী বাঙালি যখন অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, তখন থেকেই সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল এক অনন্য আদর্শে— দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও নৈতিকতার মিশ্রণে। তাদের এই মর্যাদা শুধু সামরিক দক্ষতা বা অস্ত্রশক্তির কারণে নয়, বরং তা এসেছে নৈতিকতার দৃঢ় মেরুদণ্ড থেকে।
আজ পাঁচ দশক পরেও সেই চেতনা অম্লান। রাষ্ট্র যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, তখন প্রথম এগিয়ে আসেন সেনা সদস্যরা। যখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে, তখনো এই বাহিনীর বীর সন্তানরা বিশ্বে শান্তি স্থাপনে আত্মনিয়োগ করেন। আর যখন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেখা দেয়, তখন জনগণের আস্থা ফিরে আসে এই বাহিনীর দিকেই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি, দলবাজি বা স্বজনপ্রীতির কারণে কত মহৎ প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়েছে— এমন উদাহরণ অজস্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য এই শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়, বরং দেশের জনগণের সর্বোচ্চ আস্থার প্রতীক। এই আস্থা শুধু অস্ত্রের জোরে নয়; এটি জন্ম নিয়েছে শৃঙ্খলা, সততা ও নিঃস্বার্থ সেবার ঐতিহ্য থেকে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, রাজনীতি ও প্রযুক্তির পরিবর্তনে নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। গুজব, বিভ্রান্তি, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা অল্পসংখ্যক সদস্যের অনৈতিক কর্মকাণ্ড— এগুলো যদি প্রশ্রয় পায়, তাহলে পুরো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে আরও দৃঢ়ভাবে পুনর্জাগরিত করা—যেখানে প্রত্যেক সদস্য বলবেন, ‘অপরাধীকে দায়ী করুন, সেনাবাহিনীকে নয়’।
ইতিহাসে দেখা গেছে— যখন কোনো বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নৈতিক দুর্বলতা প্রবেশ করে, তখন বাহ্যিক শক্তি যতই থাকুক না কেন, সেই প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি, দলবাজি বা স্বজনপ্রীতির কারণে কত মহৎ প্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়েছে—এমন উদাহরণ অজস্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য এই শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়, বরং দেশের জনগণের সর্বোচ্চ আস্থার প্রতীক।
অন্যদিকে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, যখন সামরিক বাহিনী জনগণের সঙ্গে সংযোগ হারায়, তখন সেই বাহিনী ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত সেই ভুল পথে যায়নি— তারা দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে, অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছে। কিন্তু এই ধারাবাহিক ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামাজিক আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামনে তাই আজ দুটি কাজ সমানভাবে জরুরি— একদিকে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসের বন্ধন আরও দৃঢ় করা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে শৃঙ্খলা ও নৈতিক মূল্যবোধের কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া। এই দুই দিক সমানভাবে শক্তিশালী থাকলে কোনো প্রোপাগান্ডা বা গুজবই তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারবে না। কারণ, জনগণের ভালোবাসাই সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা। এই ভালোবাসা একদিনে অর্জিত হয়নি— এটি এসেছে দীর্ঘ ত্যাগ, সততা ও নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে। এখন দায়িত্ব সেই আস্থা অটুট রাখা, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্মও একইভাবে গর্ব করে বলতে পারে— বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তারা অপরাধকে না বলে, তারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়।
সেনাবাহিনীর নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা, যা সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি জরিমানা, পদহ্রাস, সাময়িক বহিষ্কার বা গুরুতর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বহিষ্কার বা কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কোর্ট মাস্টাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। তবে নৈতিকতা শুধু শাস্তির ভয় দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় না। এটি গড়ে তুলতে হয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উদাহরণের মাধ্যমে। এজন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ, চরিত্র গঠন ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। একজন অফিসার বা সৈনিককে শেখানো হয়, ‘অস্ত্র তোমাকে শক্তি দেয়, কিন্তু নৈতিকতা তোমাকে সম্মান দেয়।’
এ কারণে সেনাবাহিনীতে নৈতিকতা শুধু ব্যক্তিগত মূল্যবোধ নয়, এটি প্রাতিষ্ঠানিক বেঁচে থাকার শর্ত। বাহিনীর সুনাম, কার্যকারিতা, এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি— সবকিছুই এর সঙ্গে সম্পর্কিত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দীর্ঘকালীন সফলতা এসেছে এই নৈতিক সংস্কৃতি থেকেই। যেখানে অনেক দেশের সৈন্য দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অসদাচরণের অভিযোগে বিতর্কে জড়িয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সেনারা সবসময় পেশাদারিত্ব ও সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বিশ্বের ইতিহাসে দেখা গেছে, যেসব দেশে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও বাহিনীর ভাবমূর্তি— দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তান, মিয়ানমার কিংবা আফ্রিকার কিছু রাষ্ট্র এর উদাহরণ। সেখানে রাজনীতি সেনাবাহিনীর মধ্যে দলীয় বিভাজন এনেছে, আর সেনাবাহিনী রাজনীতির খেলায় জড়িয়ে পড়েছে নিজের অজান্তেই।
ফলাফল— প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার অবক্ষয় ও জনগণের আস্থাহানি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত এই বিপজ্জনক পথ থেকে দূরে থেকেছে, যা একটি বড় সাফল্য।
আজকের যুগে রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। সেনাবাহিনীর অনেক অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এখন বেসামরিক প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, যা এক অর্থে স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার; কিন্তু অন্যদিকে এটি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিতে সূক্ষ্ম প্রভাব ফেলতে পারে। জনগণ প্রায়ই সক্রিয় বা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডকে বাহিনীর অফিসিয়াল অবস্থানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। এই বিভ্রান্তি দূর করতে সেনাবাহিনীর উচিত আরও স্পষ্ট যোগাযোগ নীতি গ্রহণ করা— যেখানে বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ও ব্যক্তিগত মতের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য থাকবে।
এ ছাড়া দেশের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি ঝুঁকে পড়া— যদি বাহিনীর কিছু সদস্যের মধ্যেও দেখা দেয়— তাহলে সেটি বাহিনীর পেশাদারিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি। একইভাবে, অর্থনৈতিক প্রভাব ও করপোরেট অংশগ্রহণের বিষয়টিও এখন আলোচনায় আসে। একজন পেশাদার সৈনিক রাজনীতির দিকে তাকান না; তিনি তাকান তার দায়িত্ব, কর্তব্য এবং জাতির সম্মানের দিকে। রাজনীতি ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্ব স্থায়ী। এই নীতি অনুসরণ করেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা কুড়িয়েছে— বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে, যেখানে নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা হলো মূল মাপকাঠি।
রাজনীতি ও ক্ষমতার প্রলোভন প্রতিটি সমাজেই থাকে। কিন্তু যে বাহিনী এই প্রলোভনকে অগ্রাহ্য করে, সেই বাহিনীই টিকে থাকে ইতিহাসে সম্মানের সঙ্গে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা এসেছে দীর্ঘদিনের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক প্রশিক্ষণের ফলে। এই অবস্থান অটুট রাখতে হলে বাহিনীর ভেতরে ‘রাজনীতির প্রতি নিরপেক্ষতা’কে একটি সাংস্কৃতিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ শুধু দেশের সীমান্তরক্ষী নয়— তারা পৃথিবীর শান্তিরক্ষী। জাতিসংঘের নীল পতাকার নিচে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈন্যরা যে সম্মান অর্জন করেছেন, তা শুধু সামরিক সাফল্য নয়, এটি এক অনন্য মানবিক ইতিহাস। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অংশগ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাহিনীটি ৪০টিরও বেশি দেশে ৫৫টিরও বেশি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে কর্মরত, যার মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য ছাড়াও নারী শান্তিরক্ষীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বিশ্বের শীর্ষ তিন অবদানকারী দেশের একটি, যা একদিকে জাতির জন্য গর্ব, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলা, মানবিক সংবেদনশীলতা এবং নৈতিক নিরপেক্ষতা ভূমিকা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডে বিশেষভাবে প্রশংসিত; কিন্তু এই গৌরব অর্জনের পথ একেবারে সহজ ছিল না। ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহু বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৮০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কর্তব্যরত অবস্থায় প্রাণ দিয়েছেন। তারা রক্ত দিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদার ইতিহাস।
এই আত্মত্যাগ শুধু সংখ্যায় পরিমাপযোগ্য নয়। শান্তিরক্ষীরা বিদেশে কর্মরত থেকে পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, যা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব একাধিকবার বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন— বিশেষত নারী শান্তিরক্ষীদের ভূমিকার জন্য। ২০২৩ সালে জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষায় বৈশ্বিক নেতৃত্বের উদাহরণ।’
এককথায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ যে মর্যাদা ও বিশ্বাসের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা। অপরাধ ও দুর্নীতিকে ‘না’ বলা কেবল একটি স্লোগান নয়— এটি সেনাবাহিনীর আত্মপরিচয়ের অংশ। এই চেতনাই বাহিনীকে অনন্য করে তুলেছে— দেশের ভেতরেও, আন্তর্জাতিক পরিসরেও। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা ও নৈতিকতা, ভাবমূর্তির আন্তর্জাতিক প্রতিফলন, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং প্রযুক্তি ও তথ্যযুদ্ধ, প্রতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও তথ্য-নিরপেক্ষতার ভারসাম্য বজায় রেখেছে— সামরিক শক্তি ও নৈতিক শক্তির মধ্যকার সঠিক সমন্বয়।
কোনো পেশাদার বাহিনীর ভেতরে যদি কিছু সদস্য লোভ, ক্ষমতা বা প্রভাবের প্রলোভনে নীতিভ্রষ্ট হয়, তবে তা শুধু একটি ব্যক্তির নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করে। গণমাধ্যম বা সামাজিক প্ল্যাটফর্মে একটি অপরাধের খবর, সেটি যত ক্ষুদ্রই হোক, বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সাধারণ মানুষ বাহিনীর নৈতিকতার ওপর প্রশ্ন তোলে— যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সৎ ও নিষ্ঠাবান। তবে এর দায় কেবল বাহিনীর নয়; নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বশীল অংশকেও সমানভাবে সচেতন হতে হবে। গুজব ও প্রোপাগান্ডার যুগে তথ্য যাচাই না করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করা কেবল একটি বাহিনী নয়, পুরো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোকেই দুর্বল করে।
বাংলাদেশে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে এবং সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে উচ্চপদস্থ কিছু সেনা কর্মকর্তাদের নামে যে “আয়নাঘর ‘গুম-খুন’ বা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট” ইত্যাদি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রায়ই সেনাবাহিনীকে সরাসরি যুক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তবে বাস্তবতা হল, এই ধরনের কার্যক্রমে যারা জড়িত, তারা মূলত ব্যক্তিগত লোভ, লালসা বা সরকারের চাপে বাধ্য হয়ে এমন কাজ করেছে। এটি কোনোভাবেই পুরো সেনাবাহিনী বা তার নীতি ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
সেনাবাহিনী দেশের আইন ও সংবিধানের প্রতি অঙ্গীভূত এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে অনিয়ম বা অপরাধমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হয় না। তাই এই ধরনের ঘটনাগুলোকে পুরো সেনাবাহিনীর নামে প্রচার করা তথ্যবহুল নয় এবং বিভ্রান্তিকর। বাস্তবধর্মী মূল্যায়ন নির্দেশ করে যে, এ ধরনের অপরাধ মূলত ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও নৈতিক পতনের ফল, যা রাষ্ট্রীয় আইন এবং বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কঠোর শৃঙ্খলা, সংবিধানমুক্ত কার্যক্রম এবং দেশপ্রেমের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বা সাবেক কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পুরো সেনাবাহিনীর সঙ্গে মেলানো ভিত্তিহীন এবং প্রকৃত সত্যের বিপরীত।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল একটি সামরিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি জাতির নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রতীক। ‘সেনাবাহিনীকে নয় বরং অপরাধীকে দায়ী করুন’ নীতি এই প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি। এই প্রবাদবাক্য কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি সেনাবাহিনীর নৈতিক চেতনা, শৃঙ্খলা এবং পেশাদারিত্বের প্রতিফলন। প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে এই নীতি বাস্তবায়নই বাহিনীর শক্তি, জনগণের আস্থা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে।
(লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected])