রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাতটি সরকারি কলেজকে ঘিরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি) গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতি’ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেছে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাডার সার্ভিস বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ১৮ হাজার সদস্যের পেশাজীবী সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করছে। এ বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির পর্যবেক্ষণ
১. সাতটি সরকারি কলেজ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক। এগুলোকে হঠাৎ করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা বা প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করা জাতীয় স্বার্থ ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী।
২. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার সাতটি কলেজকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সময় যথাযথ সমীক্ষা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এটি ছিল ব্যক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত, যার ফলে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসে, যা ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
৩. বাংলাদেশের কলেজপর্যায়ে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চশিক্ষার গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। ঢাকা কলেজ ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা চালু করে। এই ধারায় কলেজভিত্তিক উচ্চশিক্ষা জাতির জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে।
৪. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসারে সারা দেশে কলেজভিত্তিক স্নাতক শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে এবং তা দেশের উচ্চশিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৫. নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। সাত কলেজে শিক্ষার সুযোগ সীমিত করলে শিক্ষার্থীকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে, যা নীতিগতভাবে শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
৬. শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে কলেজভিত্তিক উচ্চশিক্ষা পরিচালনা করতে সক্ষম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও চিকিৎসকদের মতো তারাও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় পারদর্শী হতে পারে।
৭. সাত কলেজে শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করলে জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো সমরূপ দাবি উত্থাপন করতে পারে, যা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সুপারিশ
১. ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজের বিদ্যমান প্রশাসনিক ও আর্থিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। এই কলেজগুলো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে তা অবশ্যই যথাযথ আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রস্তাবিত কাঠামোয় কলেজের বিদ্যমান সক্ষমতা, অবকাঠামো ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে, এ কলেজগুলোকে কলেজিয়েট বা অধিভুক্তিমূলক কাঠামোয় রূপান্তর করা যেতে পারে, অথবা ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথক ক্যাম্পাসে স্থাপন করে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা যেতে পারে।
২. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক যথাযথ সমীক্ষা পরিচালনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অধ্যয়নরত সব শিক্ষার্থীর জন্য অভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি, গবেষণা বাজেট বরাদ্দ, আধুনিক ল্যাব, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, আবাসন ও বৃত্তি সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানী, মেট্রোপলিটন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখা যাবে না।
৩. শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি পাঠদানকৃত বিষয়সমূহ ও সিলেবাস পুনর্বিবেচনা করে যুগোপযোগী করতে হবে।
৪. বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণে এই পেশার শীর্ষ পদ মহাপরিচালককে আস্থায় নিতে হবে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে হবে।
৫. রংপুর কারমাইকেল কলেজের পরিবর্তে ভিন্ন ক্যাম্পাসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিএম কলেজের পরিবর্তে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে প্রয়োজনে নতুন ক্যাম্পাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
৬. সর্বোপরি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্বার্থ সুরক্ষা করে শিক্ষার পরিবেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাত কলেজ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গৌরবময় ঐতিহ্যের অংশ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, যার মধ্যে ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেছা মহিলা কলেজ নারী শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। জাতীয় ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতায় এসব কলেজকে বিলুপ্ত বা একীভূত করার উদ্যোগ অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত হবে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি বিশ্বাস করে, সব অংশীজনের মতামতের আলোকে শিক্ষার্থীবান্ধব, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান গ্রহণের মাধ্যমেই জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা সম্ভব।
এএএইচ/এমএমকে/এএসএম