একসময় দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি ছিল পাট। সোনালি আঁশ খ্যাত এই ফসল এখন যেন হারাতে বসেছে। দিন দিন নিত্য পণ্যের দাম বাড়লেও বাড়ছে না পাটের দাম। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের এই ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পাটচাষে আগ্রহ নেই চাষিদের মাঝে।
উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা এখনও এই ফসলের ওপর নির্ভরশীল হলেও বছরের পর বছর ন্যায্যদাম না পাওয়ায় তাদের মুখে এখন কেবল হতাশা। চলতি মৌসুমে বাজারে পাটের দাম কিছুটা বাড়লেও সেই বাড়তি মূল্য গায়ে লাগেনি চাষিদের। কারণ শুরুতেই বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তারা। এখন দাম বাড়লেও অধিকাংশ কৃষকের ঘরে পাট নেই— আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৬ বছর ধরেই কমছে পাটের আবাদ। ২০২১ সালে জেলায় যেখানে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয়েছিল, ২০২২ সালে তা নেমে আসে ১৪ হাজার ৩১৩ হেক্টরে। পরের বছরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ২০২৪ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৭৯০ হেক্টর। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামান্য ৩২ হেক্টর জমিতে আবাদ বাড়লেও এখনো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি কৃষি বিভাগ।
উত্তরের এই জেলায় কয়েক বছর আগেও কৃষকদের জমিতে পাট গাছের সবুজ সমারোধ ছিল, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে অন্য ফসল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে দৃশ্যপট। পাট আবাদে খরচ বেশি এবং ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চাষাবাদ থেকে বিমুখ হচ্ছেন কৃষকরা। উৎপাদন খরচ বাড়লেও বাড়ছে না পাটের দাম, বরং কমছে। প্রতি বছর ভালো দাম পাওয়ার আশায় পাটচাষ করলেও লোকসানের মুখে পড়ছেন কৃষকরা। কষ্ট করে চাষ, জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে বাজারে নিয়ে এলেও দাম না পেয়ে হতাশ কৃষকরা। এমন অবস্থায় পাট চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা।

সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন হাটে দেখা গেছে, প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ দেড় মাসে দাম বেড়েছে মণপ্রতি প্রায় এক হাজার ২০০ টাকা। তবুও এতে লাভবান হচ্ছেন না কৃষকরা। কারণ অধিকাংশ কৃষক আগেই ধার-দেনা শোধ দিতে পাট বিক্রি করে দিয়েছেন কম দামে। যারা মজুত রেখে ছিলেন তারাই এখন লাভের ভাগ নিচ্ছেন।
গাইবান্ধার ফুলছড়ির চরাঞ্চলের কৃষক মতি মিয়া বলেন, ‘এখন দাম ভালো, কিন্তু আমাদের ঘরেতো পাট নাই। কাটার সময় বিক্রি করেছি ২৮০০ টাকায়। তখন না বিক্রি করলে ধার শোধ হতো না। যারা মজুত রেখেছে, তারাই এখন লাভ করছে।’
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, হাট-বাজারে পাটের দাম নির্ধারণ করেন পাটকল মালিক ও ফড়িয়া-সিন্ডিকেটরা। মৌসুমের শুরুতে তারা কম দামে পাট কিনে মজুত রাখেন, পরে বাজারে চাহিদা বাড়লে বাড়িয়ে দেন দাম। ফলে কৃষক বঞ্চিত হন ন্যায্য দামে বিক্রির সুযোগ থেকে।
আরও পড়ুন-
পাট চায় নেপাল
কাঁচাপাটের সংকট, রপ্তানি বন্ধ চান ব্যবসায়ীরা
সড়কে বদলে গেছে কৃষির চিত্র
কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের কৃষক সোবাহান মিয়া বলেন, ‘এখন সার, বীজ, শ্রমিক— সবকিছুর দাম বেশি। আবার ঝুঁকি নিতে হয় বন্যা-খরার। এত কষ্ট করে চাষ করে লাভ হয় না। তারপরও চরাঞ্চলে এই সময় পাট ছাড়া কিছুই করা যায় না।’
একই গ্রামের নাজমুল হোসেনের আক্ষেপ, ‘সরকার যদি মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকের কাছ থেকে পাট কিনতো, তাহলে আমরা বাঁচতাম। এখনতো আমরা শুধু সিন্ডিকেটের হাতে মরছি।’
অন্যদিকে পাইকাররা বলছেন, তারা পাটের দাম নির্ধারণ করেন না। বড় মিল মালিকরাই বাজারে প্রভাব বিস্তার করেন।

ফুলছড়ি হাটের পাইকার শাহ আলম বলেন, ‘আমরা স্থানীয়ভাবে পাট কিনি, কিন্তু দাম ঠিক হয় ঢাকার মিল মালিকদের নির্দেশে। আমরা শুধু তাদের দেওয়া দামে ক্রয়-বিক্রয় করি।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষকরা এখন পাট চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। তবে আশার আলোও দেখছেন অনেকে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ থাকলে আবারও ফিরতে পারে সোনালি আঁশের সোনার দিন।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পাটের বাজার ভালো। কৃষকদের পাটচাষে উৎসাহিত করতে এ বছর জেলায় দুই হাজার কৃষককে বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। তবে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলেই কৃষকদের পাটচাষে আগ্রহ ফিরে আসবে।
এফএ/এমএস

2 days ago
13








English (US) ·