স্কুল পড়ুয়া শিশুকে যেসব মৌলিক শিক্ষা দেবেন

2 days ago 14

শহরের নামকরা স্কুলটিতে শিশুকে ভর্তি করানোর জন্য বাবা-মায়েরা করেনা এমন কিছু নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোচিংয়ের সামনে বসে থাকা থেকে শুরু করে ৪-৫টা হোম টিউটর দিয়ে দিচ্ছেন অনেকেই। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাস্তবিক জীবনে চলার মৌলিক শিক্ষাগুলো কি দিচ্ছেন তাদের?

পাঠ্যপুস্তকের পড়াশোনা যে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অত্যাবশ্যক, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে পাঁচ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য জীবনের মৌলিক দক্ষতা বা লাইফ স্কিল শেখার আদর্শ সময় এটি। জীবনের মৌলিক দক্ষতা আসলে কী কী? এ প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। একটা প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়েই বিষয়টি বোঝা যাবে। প্রশ্নটি হলো- একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিনের জীবনে বেঁচে থাকতে ও সমাজে চলতে কী কী কাজ করতে হয়? সে সবই জীবনের মৌলিক দক্ষতা।

তবে সব শিক্ষা সব বয়সের জন্য উপযোগী না। তাই শিশুকে লাইফ স্কিল শেখানোর ক্ষেত্রে সঠিক বয়সে সঠিক শিক্ষাটি দেওয়া জরুরি। জেনে নিন আপনার পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুকে কী কী দক্ষতা শেখানো প্রয়োজন-

স্কুল পড়ুয়া শিশুকে যেসব মৌলিক শিক্ষা দেবেন

১. আত্মবিশ্বাস ও আত্মরক্ষা
প্রাথমিকভাবে শিশুর আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় বাবা-মা বা অভিভাবকের কাছে থেকেই। বাড়িতে অন্যান্য সদস্যদের মধ্যকার সুসম্পর্ক ও অভিভাবেকের সঙ্গে শিশুর সুসম্পর্ক এর প্রথম ধাপ। তবে ছোট ছোট সাফল্যে শিশুকে উৎসাহীত করা, তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে শোনা ও শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে ট্রিট করার মধ্য দিয়ে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। এই আত্মবিশ্বাসই আপনার সন্তানকে অনেক কঠিন সময় মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে। এছাড়া বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আপনার শিশুকে আত্মরক্ষার প্রথম পাঠ দিন। একদিকে যেমন তাকে মারামারি বা ভায়োলেন্সে নিরুৎসাহিত করবেন, অন্যদিকে তাকে নিজের বাউন্ডারি ঠিক করতে উৎসাহীত করুন। কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে অনিরাপদ বোধ করলে কীভাবে বাঁচতে হবে, সেই শিক্ষা দিন। আত্মবিশ্বাস ও আত্মরক্ষার এই শিক্ষা শুরু হতে পারে শিশু কথা বুঝতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই।

২. ‘না’ বলা
না বলতে শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। ছোটবেলা থেকেই শিশুর মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে শোনার মাধ্যমে এই চর্চা শুরু করুন। এমন নয় যে অভিভাবক হিসেবে শিশুর সকল মতামত বা দাবি মেনে নেবেন। শিশু অনেকসময় স্কুলে যাওয়া, পড়তে বসা, গোসল করা, খাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কাজও না করতে চাইতে পারে। এমন সময়ে তার কথা ধৈর্য নিয়ে শুনুন এবং তাকে বলুন এটা কেন জরুরি এবং ভালো না লাগলেও করতে হবে। এই চর্চার মাধ্যমে শিশু জানবে যে তার মতামত আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাইরের কেউ তাকে কোন বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করলে সে ‘না’ বলবে এবং আপনার কাছে বিষয়টি শেয়ার করবে। আপনার শিশু কোন আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে যেতে না চাইলে জোর করবেন না, বরং আলাদা করে এর কারণ সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করুন।

স্কুল পড়ুয়া শিশুকে যেসব মৌলিক শিক্ষা দেবেন

৩. অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়
আপনার শিশু স্কুল থেকে ফেরার পথে বা বাইরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ আপনার থেকে আলাদা হয়ে গেলে যেন আপনার সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারে, এ বিষয়টি নিশ্চিত করুন। শিশুর বয়স ৪ বছরে হলেই আপনার সম্পূর্ণ নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরটি তাকে আত্মস্থ করান।

৪. কারো তত্ত্বাবধান ছাড়া খাওয়া
আপনার শিশু স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই তাকে একা একা খেতে শেখান। তার সামনে যথাযথ খাদ্য রাখলে যেন সে প্রয়োজনমতো খাবার নিজেই খেতে পারে কারো সাহায্য ছাড়া। তবে সেই সঙ্গেই এটাও শেখান যেন অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া অপরিচিত কারো কাছে কিছু সে না খায়।

৫. নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা
স্কুলে যেতে শুরু করার আগেই শিশুকে শেখান টয়লেট ব্যবহারের পর কীভাবে নিজেকে ঠিকমতো পরিচ্ছন্ন করতে হয়। ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়ের ক্ষেত্রেই বয়ঃসন্ধিকালে পা ফেলবার আগেই তাদের গোসলের সময় নিজেকে ঠিকমতো পরিষ্কার করতে শেখান। সেই সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানান।

স্কুল পড়ুয়া শিশুকে যেসব মৌলিক শিক্ষা দেবেন

৬. নিজের কাজের পরিকল্পনা করা
আপনার সন্তান তার ক্লাসের পড়াশোনা, খেলাধুলা, পরীক্ষার সিলেবাস-রুটিন, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি ইত্যাদি যেন নিজেই পরিকল্পনা করতে পারে, সেই শিক্ষা দিন। প্রয়োজনে আপনার সাহায্য নেওয়ার রাস্তা অবশ্যই খোলা রাখবেন।

৭. প্রাথমিক চিকিৎসা
খেলার সময় হঠাৎ ছোট আঘাত পেলে কী করতে হবে, অর্থাৎ প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে সন্তানকে সচেতন করুন। সেই সঙ্গে শেখান নিজে নিজে যেন কখনও কোন ওষুধ মুখে না দেয়।

৮. নিজের জামা-কাপড় ও ঘর গোছানো
সন্তান সাত-আট বছরে পা রাখলে তাকে শেখান কীভাবে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হয়। ঘুম থেকে উঠে নিজের বিছানা গোছানোর অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষা শুরু করতে পারেন। এরপর ধীরে ধীরে স্কুলের ইউনিফর্ম প্রস্তুত করা, ব্যাগ গোছানো, আলমারি গোছানো ইত্যাদি শেখাতে পারেন।

৯. সাঁতার
সাঁতার শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লাইফ স্কিল। জীবনের যেকোন সময়ই এটা শেখা যায় তবে শিশুদের জন্য সাঁতার শেখা বড়দের চেয়ে অনেক সহজ। এছাড়া পানিতে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো দুর্ঘটনা এড়াতে আপনার শিশুতে ছোট বয়সেই সাঁতার শেখান।

১০. বিপদে পড়লে কী করবে
কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সামনে পড়লে বা কোন কারণে যদি শিশু নিজেকে বিপদগ্রস্ত অনুভব করে, তখন তার কী করা উচিত? এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই তার সঙ্গে আলোচনা করুন। শিশুকে জানিয়ে রাখুন আশেপাশের কাকে সে বিশ্বাস করবে। কীভাবে দ্রুততম সময়ে সাহায্য খুঁজে বের করবে ও আপনাকে যোগাযোগ করবে।

একটি শিশু তার জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনের জন্য বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে। তাই এই সমাজে সে কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখবে ও স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে সেটা শেখানোর দায়িত্বও অভিভাবকের ঘাড়েই থাকে। আপনার শিশুকে পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত মানুষে পরিণত করার মধ্যেই আপনার প্যারেন্টিংয়ের সাফল্য রয়েছে। তবে স্বাবলম্বী হওয়া মানে এই নয় যে সন্তানের জীবনে বাবা-মায়ের প্রয়োজন কখনও ফুরিয়ে যাবে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানও বাবা-মায়ের কাছে আজীবন আদরের বাচ্চাটিই থাকে।

এএমপি/জেআইএম

Read Entire Article