১৮ বছর বয়সী এক তরুণ মেহেদী হাসান আকাশ। সাধারণত এই বয়সের ছেলেরা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও ঘোরাঘুরি করে থাকে। তবে আকাশের কথা ভিন্ন। জীবন-জীবিকার তাগিদে পড়াশোনার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নিজেই হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। সকালে কলেজ, আর বিকেলে বসেন খাবারের দোকান নিয়ে। বিক্রি করেন সামুদ্রিক মাছসহ বিভিন্ন মজাদার খাবার। এখান থেকে গড়ে মাসে তার বিক্রি হয় আড়াই লাখ টাকা। এই বয়সেই তিনি বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তার মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো লাভ থাকছে। নিজেই যে স্বাবলম্বী হয়েছেন তা কিন্তু নয়, আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
মাদারীপুর পৌরশহরের উকিল পাড়া এলাকার আলমগীর মুন্সি ও কাজল বেগমের ছেলে আকাশ। তার বাবাও একজন ব্যবসায়ী। এক বোন ঢাকাতে পড়াশোনা করেন। মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আকাশ।
নিজে কিছু করবেন এবং মাদকের নেশা থেকে মুক্ত থাকার চিন্তা থেকেই মাদারীপুর শহরের শকুনি লেকপাড়ের ফুটপাতে শুরু করেন ‘কাবাব ক্যাব’ নামে একটি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। প্রথমে কাবাব, লুচি বিক্রি শুরু করেন। এরপর হাঁসের মাংস ও পরোটা। দিন দিন বেচাকেনা বাড়তে থাকে।
খোলা জায়গা, সুন্দর পরিবেশ ও খাবারের মান ভালো হওয়ায় অল্প দিনেই হাঁসের মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে করে আকাশের ব্যবসার প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়। নতুন পদ বাড়ানোর চিন্তা করেন। পরে কুয়াকাটা থেকে কোরাল, রূপচাঁদা, টোনা, চিংড়ি, লইট্টা, কাঁকড়া, লাক্ষা, তেলাপিয়াসহ নানা সামুদ্রিক মাছ এনে, তা ভেজে বিক্রি শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ সাড়া পড়ে যায়। লেকপাড়ে বসে সমুদ্রের মাছ ভাজা গরম গরম খেতে খুব পছন্দ খাদ্যপ্রেমীদের।
ভ্রাম্যমাণ চুলোর সামনেই সমুদ্রের কাচা মাছগুলোকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। ক্রেতারা এসে তাদের পছন্দমতো মাছ খাওয়ার কথা বলেন। তখন তাদের সামনেই মাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়। পরে বিভিন্ন মসল্লা দিয়ে সেগুলো ভেজে ক্রেতাদের সামনে দেওয়া হয়। বিকেল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে এই বিক্রি। খাদ্যপ্রেমীরা মাছের সঙ্গে লুচি ও পরোটাও খেয়ে থাকেন। অনেকেই আবার মাছ ভেজে বাড়ির জন্য নিয়ে যান।
সামুদ্রিক মাছ, হাঁসের মাংসের পাশাপাশি চিকেন তন্দুরি, চিকেন বারবিকিউ, বটি কাবাব, অ্যারাবিয়ান রেশমি কাবার, চিকেন হরিয়াল টিক্কা, মোরগ মাখ্যান, গরুর মাংসের শিক, বাদশাহী ললিপপ, মাসালা চিকেন চাপ, চিকেন মোমোস, নাগা মোমোস, ফ্রাইড মোমোস, লুচি, চাপতি পিঠা, শাহী পরোটা, চুই ঝাল, দেশি মুরগিসহ নানা মজাদার খাবার বিক্রি করা হয়।
প্রতিদিন সকালে কলেজ যান আকাশ। এরপর দুপুরে বাসায় ফিরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বিকেলেই চলে আসেন লেকপাড়ে নিজের কাবাব ক্যাবে। ছয়জন কর্মচারী কাজ করেন এখানে। প্রতিদিন ৭-৮ হাজার টাকা বিক্রি হয়। শুক্র ও শনিবার ১০-১২ হাজার টাকার খাবার বিক্রি হয়। এই দুদিন লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে হয় ক্রেতাদের। প্রতি মাসে গড়ে তার আড়াই লাখ টাকার মতো খাবার বিক্রি হয়। লাভ থাকে ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো। আগামীতে ব্যবসা আরও বড় করবেন বলে জানান মেহেদী হাসান আকাশ।
স্থানীয় কে এম জুবায়ের হাসান খান বলেন, আকাশ মাত্র একাদশ শ্রেণিতে পড়েন। এই অল্প বয়সে এভাবে ব্যবসার কথা চিন্তাই করা যায় না। আকাশকে দেখে আরও যুবকরা এগিয়ে আসবেন বলে আমি মনে করি।
খাবার খেতে আসা সোহাগ হাসান বলেন, আসলে সমুদ্রের মাছ এখানে পাওয়া যাবে, তা ভাবাই যায় না। লেকপাড়ে বসে সমুদ্রের মাছের স্বাদ নেওয়া খুব আনন্দ ও মাজার ব্যাপার।
আরেক ক্রেতা আয়াত হাসান বলেন, কুয়াকাটা বা কক্সবাজারে গেলে সমুদ্রের মাছ খাওয়া যায়। কিন্তু মাদারীপুরের লেকপাড়ে এই মাছ পাওয়া যায়, শুনে খেতে এসেছি। দারুণ মজা। আমি প্রায় আমার পরিবার নিয়ে এখানে মাছ খেতে আসি। তবে মাঝেমধ্যে হাঁসের মাংসও খাই। এখানের সব রান্নাই ভালো।
খেতে আসা লাবনী বেগম বলেন, লেকপাড়ে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট থাকলেও এখানে খোলা পরিবেশে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেতে ভালোই লাগে।
মেহেদী হাসান আকাশ বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসাটা শুরু করেছি। আমার বয়সের অনেকেই দেখি বাজে আড্ডা দেয়, নেশা করে। আসলে এগুলো আমার পছন্দ না। তাই ভালো সময় কাটানোর জন্য, নেশা ও বাজে আড্ডা থেকে দূরে থাকা ও নিজের কর্মসংস্থানের জন্যই ব্যবসাটা শুরু করেছি। এখান ছয়জনকে কাজের ব্যবস্থাও করে দিতে পেরেছি। তবে এভাবে ব্যবসাটা অল্প সময়েই সফলতা আসবে তা ভাবতেও পারিনি। আমাদের রান্না করা হাঁসের মাংস ও সামুদ্রিক মাছ ভাজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে শুক্রবার লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও খাবার খান ক্রেতারা। তাই ক্রেতাদের পছন্দমতো আরও খাবারের আইটেম বাড়িয়ে ব্যবসাটা অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই।
মাদারীপুরের উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান খান বলেন, আকাশ এত অল্প বয়সে পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করছেন, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সকালে কলেজ করেন, বিকেলে করেন ব্যবসা। বর্তমানে এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশা করছি তাকে দেখে আরও অনেক যুবক নিজের কর্মসংস্থান নিজেই খুঁজে নেবেন।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/জেডএইচ/এমএস