- পাথর আমদানিতে সীমাবদ্ধ
- প্রতি বছর কমছে রাজস্ব
- কর্মহীন কয়েকশো শ্রমিক
- অন্য বন্দরে ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা
২০১৫ সালের জুন মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জমির ওপর নির্মিত শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও স্থলবন্দর। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বন্দর চালু হলেও কার্যত অর্থনৈতিকভাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি এটি। ভারত ও ভুটান থেকে ১৯টি পণ্য আমদানির অনুমতি থাকলেও কেবল পাথরেই আটকে আছে কার্যক্রম।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁওয়ে শুল্ক বন্দরের কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছর পর ২০০২ সালে এক প্রজ্ঞাপনে পাথর ও কয়লা ছাড়া সব ধরনের পণ্যের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ফের ২০০৯ সালে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে চালুর ঘোষণা দেন তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। এরপর ২০১১ সালের শেষের দিকে তিনি পূর্ণাঙ্গ বন্দরের অবকাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় সাড়ে ১৩ একর জমির ওপর ১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় অবকাঠামো। জনবলও নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে নাকুগাঁও থেকে নকলা উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়কের কাজ করা হয়।
এই বন্দর দিয়ে আমদানিযোগ্য পণ্যগুলো হলো- পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, বল ক্লে, কোয়ার্টাজ, চায়না ক্লে, গবাদি পশু, কাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, বৃক্ষ, বীজ, গম, মরিচ, রসুন ও আদা।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে নাকুগাঁও স্থলবন্দরে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদায় হয়েছে প্রায় পৌনে ছয় কোটি টাকা, আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৭১ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে স্থলবন্দরটি। এ অবস্থায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের হিসাবও দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি অংশ এবং ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরটি। ঢাকঢোল পিটিয়ে অবকাঠামো তৈরি করা হলেও এতদিনেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি এটি। এলসি করেও পণ্য আমদানি করতে না পারায় লোকসান গুনে এই বন্দর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে পার্শ্ববর্তী গাবরাকুড়া স্থলবন্দর, কড়ইতলা স্থলবন্দর ও কামালপুর স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে ঝুঁকছেন তারা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ-ভুটানের ভৌগোলিক অবস্থান কাছাকাছি থাকলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগোচ্ছে না। আর এর কারণ হচ্ছে ভারতের ট্রানজিট সমস্যা। ভারতের নাগরিকরা ভুটানের গাড়িতে নানানভাবে হয়রানি করে।
আরও পড়ুন-
সোয়া দুই কোটি টাকা খরচে স্কেল স্থাপন, মিলছে না সুফল
নামমাত্র রপ্তানিতে বেঁচে আছে বিলোনিয়া স্থলবন্দর
অপার সম্ভাবনায় বাধা স্থান সংকট-সংকীর্ণ মহাসড়ক
বন্দরের ব্যবসায়ী ছাইফুল ইসলাম বলেন, পাথর ছাড়া অন্য কোনো পণ্য এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আনা যায় না। কালেভদ্রে কয়লা এলেও তা অত্যন্ত নিম্নমানের, পরে যা বিক্রি করা যায় না। আমরা ভুটানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলেছি, কিন্তু ভারতের ঢালুতে তাদের গাড়ি আটকে নানানভাবে হয়রানি করে। তাই তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায় না। এছাড়াও ভারতের কয়লার হাট থেকে পণ্য আনতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। দূরত্ব বেশি হওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ফলে পণ্য আমদানিতে লোকসান গুনতে হয়। এই বন্দর দিয়ে আমদানিযোগ্য পণ্যগুলোর শুল্ক কমিয়ে দিলে আমরা বিনিয়োগ বাড়াবো। নয়তো এখানে আর ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
ব্যবসায়ী আবুল হাসান বলেন, আগে যেখানে ভারত ও ভুটান থেকে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক আসত, এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫টি ট্রাক আসছে। তাও মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকে। যদি আমরা পাথর, কয়লা ছাড়া আরও অনুমোদিত চার থেকে পাঁচটি পণ্য নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে এই বন্দর দেশের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে পরিণত হতো। কিন্তু আমরা বারবার এসি রুমে বসা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বড় বড় আশ্বাসের গল্পই শুনেছি। যা বাস্তবে ছিল ফাঁকাবুলি। আমরা এখন পার্শ্ববর্তী বন্দরের দিকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছি।
বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির তথ্যমতে, সমিতির অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ২৫০ জন। এর মধ্যে ভারত থেকে পাথর আমদানি করেন শতাধিক ব্যবসায়ী। কিন্তু কেবল পাথরেই আটকে রয়েছে বন্দর, বাকি পণ্যের ব্যবসায় কোনো সাড়া নেই। তাছাড়া বারবার এলসি আটকে যাওয়ায় এখন অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা এই বন্দর থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, নাকুগাঁও বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আট শতাধিক। এছাড়া দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করেন আরও প্রায় এক হাজার শ্রমিক। যদি এই বন্দর দিয়ে অনুমোদিত ১৯টি পণ্য আসতো তাহলে আরও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু বন্দরের এমন অচলাবস্থায় শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
ক্রাশিং মেশিনে পাথর ভাঙা, নেটিং ও উত্তোলনের কাজে জড়িত হজুরা বানু, মাহেল কোচ, হারাময় রাণীসহ কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করে তারা প্রায় চারশো টাকা মজুরি তুলতে পারেন। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে একদম বেকার হয়ে পড়েছেন তারা। এজন্য দ্রুত বন্দরটিকে ফের কর্মময় করে তোলার অনুরোধ জানান তারা।
নাকুগাঁও স্থলবন্দর লোড-আনলোড শ্রমিক ইউনিয়নের একজন শ্রমিক বলেন, বন্দরের শ্রমিকদের মধ্যে যারা ইউনিয়নভুক্ত তাদের মজুরি বেশি। তারা দৈনিক সাতশো থেকে আটশো টাকা পর্যন্ত মজুরি তুলতে পারেন। আবার দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক শ্রমিকের মজুরি তুলনামূলক কিছুটা কম। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলে অন্য কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় তারা পুরোপুরি বেকার। আর এই শ্রমিকরা অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে।

সার্বিক পরিস্থিতি জানতে নাকুগাঁও আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সমিতির কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে সভাপতি তেমন একটা আসে না অফিসে। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দিয়েছি অন্যান্য পণ্য আনার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। এতে আমরা হতাশ।
সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল করিম চাঁন জাগো নিউজকে বলেন, শেরপুরের একমাত্র বন্দরটি দীর্ঘদিন ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এতে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েছেন, বেকার হয়েছেন শত শত শ্রমিক আর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
শেরপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের বন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে আসামের জাগির রোডে এশিয়ার সর্ববৃহৎ শুঁটকির হাট। দেশে চাহিদা থাকার পরও সেখান থেকে শুঁটকি আমদানি করতে পারছেন না আমাদের ব্যবসায়ীরা। শুঁটকি, কয়লা, পাথর, সুপারি, ফলমূল, ফ্লাই অ্যাশসহ অন্যান্য পণ্যও আনতে আমাদের আমদানিকারকরা আগ্রহী। অনুমোদিত পণ্যগুলো না আসায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারাঙ্গাপাড়ার ডালু স্থল শুল্ক স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত আমাদের এই বন্দরটিতে ব্যবসায় সফল হচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃপক্ষকে বন্দরটিকে কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছি।
এ বিষয়ে দায়সারা কথা জানালেন শেরপুর কাস্টম, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর কবির। তিনি জাগো নিউজকে জানান, আরও বেশি সংখ্যক পণ্য আনতে ব্যবসায়ীদের আইনগত সহযোগিতা আমরা করবো।
এফএ/এএসএম

9 hours ago
9








English (US) ·