স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর : প্রয়োজন নাকি বিতর্ক

3 hours ago 6

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ভেঙে দুটি নতুন অধিদপ্তর গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে— একটি মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, অন্যটি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর। প্রশাসনিক এই পুনর্গঠনকে ঘিরে শিক্ষাঙ্গনে চলছে তুমুল বিতর্ক। কেউ বলছেন এটি যুগোপযোগী উদ্যোগ, যা মাধ্যমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করবে, আবার কেউ মনে করছেন এটি অকার্যকর এবং শিক্ষা প্রশাসনে নতুন জটিলতার জন্ম দেবে। এই প্রেক্ষাপটে বিষয়টির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা জরুরি।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত ৩ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ভেঙে দুটি নতুন অধিদপ্তর গঠনের প্রস্তাব পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে। প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন দুটি অধিদপ্তরের নাম হবে “মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর” এবং “উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর” (বা কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর)। প্রস্তাবনাটিতে ২১ জুলাই স্বাক্ষর করেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপের মুখে প্রত্যাহার হওয়া তৎকালীন শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুয়াবের এবং ৩১ জুলাই স্বাক্ষর করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার। ২৯ আগস্ট বিষয়টি জনসমক্ষে এলে শিক্ষাক্ষেত্রে শুরু হয় তীব্র আলোচনা-সমালোচনা।

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা ও শিক্ষক এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সমর্থনমূলক কর্মসূচি শুরু করেন। তবে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা এবং শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তারা এই উদ্যোগকে অযৌক্তিক ও অকার্যকর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের দাবি, অতীতে প্রাথমিক, কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর আলাদা করা হলেও শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটেনি; বরং সেখানে সমন্বয়হীনতা বেড়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে প্রশাসন ক্যাডারের হাতে, যাদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা নেই। তাদের মতে, শিক্ষা প্রশাসনকে আরও বিভক্ত না করে একীভূত রাখা এবং দায়িত্ব শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতেই নিশ্চিত করা উচিত।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই স্তরেই শিক্ষার্থীদের ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং উচ্চশিক্ষার পথে তাদের প্রস্তুত করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই সন্তোষজনক নয়। দেশে প্রায় ২১ হাজারের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে, শিক্ষক সংখ্যা প্রায় তিন লাখ, আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখেরও বেশি। অথচ এই বিশাল পরিসরের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই, নেই পর্যাপ্ত বাজেট বা আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে মাউশির আওতায় রয়েছে ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৬৪টি জেলা শিক্ষা অফিস, ৫১৬টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ৬৮৬টি সরকারি কলেজ, ৭০৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং একটি উচ্চ মাধ্যমিক টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।

বর্তমান মাউশি একইসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব পালন করলেও এত বড় দায়িত্ব একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। এর ফলে নীতিনির্ধারণ, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, এমনকি বাজেট বণ্টনেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে যে, এত বিপুল পরিসরের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর জন্য বর্তমান কাঠামোয় কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিবর্তন এনে মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনাকে আরও গতিশীল করা জরুরি।

শিক্ষা শুধু প্রশাসনিক কাঠামো নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করলেই কেবল এই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারবে। একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের উদ্যোগ তাই সময়োপযোগী হতে পারে, তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর। যদি প্রশাসনিক ক্ষমতার খেলা বন্ধ রেখে বাস্তব সমস্যার সমাধানে জোর দেওয়া হয়, তবে মাধ্যমিক শিক্ষা একটি নতুন গতিপথে এগিয়ে যাবে।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে আমরাও মনে করি, মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। যুক্তি হলো, মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা ও প্রয়োজন আলাদা, তাই এর জন্য আলাদা একটি প্রশাসনিক কাঠামো থাকলে নীতিমালা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং তদারকিতে গতি আসবে। শিক্ষা বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষা খাতে, যেখানে মাধ্যমিক শিক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। আলাদা অধিদপ্তর হলে মাধ্যমিক স্তরের জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এছাড়া শিক্ষকদের ক্যারিয়ার উন্নয়নেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাপক বঞ্চনার শিকার। শিক্ষা নিয়ে নিয়মিত লেখার কারণে অনেক শিক্ষকের সাথে আমার কথা হয়। তারা মনে করেন, স্বতন্ত্র অধিদপ্তর হলে পদোন্নতির প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে। একইভাবে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য আলাদা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হলে মাঠপর্যায়ের তদারকি জোরদার হবে। অনেক শিক্ষক মনে করেন, বর্তমান কাঠামোয় কলেজ শিক্ষকদের আধিপত্য থাকায় মাধ্যমিক শিক্ষার চাহিদা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। নতুন কাঠামোতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের মতামত নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হলে বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত ও সমাধান করা সহজ হবে।

লেখাটি শুরু করার আগে আমার কথা হয় কয়েকজন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সাথে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র ছিলেন। তারা আবার মনে করেন, বিভাজন হলে শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে, যা শেষ পর্যন্ত নীতিগত অচলাবস্থার জন্ম দেবে। তারা উদাহরণ দিচ্ছেন প্রাথমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রের, যেখানে আলাদা অধিদপ্তর থাকা সত্ত্বেও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়নি; বরং প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসেনি।

এখানে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে— শিক্ষা কি শুধুই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে উন্নত হতে পারে, নাকি এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবসম্মত প্রয়োগ? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে পারে। শিক্ষক সমাজের একাংশের সমর্থন থাকলেও, অন্য অংশের তীব্র আপত্তি এই বিভাজন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠেলে দিয়েছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী এবং এর জন্য দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন, এবং সুষ্ঠু তদারকি নিশ্চিত করতে হলে একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো অপরিহার্য। বর্তমান মাউশি যদি এই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়, তবে বিকল্প কোনো কাঠামো ভাবা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেটি হতে হবে সুচিন্তিত, সময়োপযোগী এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত।

যদি সত্যিই একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা হয়, তবে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে এর স্বাধীনতা এবং পেশাদারিত্ব। এখানে শিক্ষকেরাই হবেন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রীয় অংশীদার। প্রশাসন ক্যাডারের অযথা হস্তক্ষেপ বন্ধ করে শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা প্রতিফলিত করতে হবে প্রতিটি নীতি ও কর্মপরিকল্পনায়। পাশাপাশি, নতুন অধিদপ্তর গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং জনবল সংকট দূর করতে হবে দ্রুততম সময়ে।

এছাড়া, নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি। আলাদা অধিদপ্তর গঠনের পরও যদি পদোন্নতি, নিয়োগ বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো না যায়, তবে এই পরিবর্তন কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। বরং এটি আরও একটি অকার্যকর দপ্তর যোগ করবে, যা শিক্ষার মূল সমস্যাগুলো সমাধান না করেই প্রশাসনিক বোঝা বাড়াবে। তবে চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে আমি মনে করি সরকারের উচিত, একতরফা সিদ্ধান্তের পরিবর্তে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যৌথভাবে একটি রূপরেখা তৈরি করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা শুধু প্রশাসনিক কাঠামো নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করলেই কেবল এই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারবে। একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের উদ্যোগ তাই সময়োপযোগী হতে পারে, তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর। যদি প্রশাসনিক ক্ষমতার খেলা বন্ধ রেখে বাস্তব সমস্যার সমাধানে জোর দেওয়া হয়, তবে মাধ্যমিক শিক্ষা একটি নতুন গতিপথে এগিয়ে যাবে।

লেখক: ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েট এন্ড কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ (বাংলাদেশ), আইএসএইচআর।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article