রোববার দুপুর ঠিক ১টা। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠলো ছুটির ঘণ্টা। মুহূর্তেই চারদিকে হাজারও শিক্ষার্থীর কোলাহল। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছে অনেকে। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো পশ্চিমদিক থেকে ছুটে আসা ৮-৯ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীর দিকে। গায়ে হাফ হাতার চেক শার্ট, পরনে কালো প্যান্ট। নাম আরিয়ান নাফিজ।
ছুটি শেষে ক্যাম্পাস ছাড়ার পথে বিমানবিধ্বস্ত হওয়া হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনে থমকে দাঁড়ালো সে। ক্ষতবিক্ষত ভবন আড়াল করতে সামনে টিনের বেড়া উঠেছে। তার সামনে কালো ব্যানারের ওপর অকালে ওপারে পাড়ি জমানো একঝাঁক কচি-কাচা মুখ।
\
পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে অতি চেনা কারও খুঁজে ফিরছে আরিয়ানের চোখ। হঠাৎ সামনে এগিয়ে গেলো সে। ব্যানারের একেবারে বামপাশে ওপরে থাকা বন্ধু মাহিত হাসান আরিয়ানের ছবিতে হাত রেখে বলে উঠলো—‘দেখো দেখো, এটা আমার বন্ধু’!
নিহত মাহিত হাসান আরিয়ান ও আরিয়ান নাফিজ দুজনই চতুর্থ শ্রেণির বাংলা মাধ্যমের দোয়েল শাখার শিক্ষার্থী। আরিয়ান নাফিজ আগে থেকেই মাইলস্টোনে পড়তো। আর মাহিত হাসান আরিয়ান এ বছরের জানুয়ারিতে অন্য স্কুল থেকে এসে মাইলস্টোনে ভর্তি হয়।
দুজনের নামের সঙ্গে আরিয়ান থাকায় ৭ মাসেই বেশ ভাব জমে উঠেছিল। আরিয়ান নাফিজের ভাষ্য, ‘ও (মাহিত হাসান আরিয়ান) খুব সাদাসিধে ছিল। অন্যরা ওকে নিয়ে মজা করতো, বোকা বলতো। কিন্তু আমার খুব ক্লোস ফ্রেন্ড (ঘনিষ্ঠ) ছিল। ওর মনটা খুব ভালো ছিল। আমরা একসঙ্গে টিফিন ভাগাভাগি করে খেতাম, খেলতাম, ঘুরে বেড়াতাম।’
‘ওর স্বাস্থ্যটা একটু হেলদি (ওজন বেশি) ছিল। এজন্য আমি সুযোগ পেলেই ওর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করতাম। ও সবসময় হেরে যেতো, আমি জিতে যেতাম। কিন্তু কখনো মন খারাপ করতো না।’
- আরও পড়ুন
- নিহত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে ৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি
- মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: চিঠির পাতায় শোক-স্মৃতি-গল্প
- ২৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলে গেলেন মাইলস্টোনের শিক্ষিকা মাহফুজা
বন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত হাসিমুখে সুখস্মৃতি বলছিল আরিয়ান নাফিজ। এবার হঠাৎ ওর মুখটা কেমন মলিন হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকে, ‘যেদিন প্লেন ক্রাশ করলো, ওইদিন আমি আর ও একসঙ্গে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিলাম। ও আমাকে রাস্তা (ভবনের সামনে) পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো। আমি একপর্যায়ে বের হওয়ার গেটের দৌড় দিলাম। আর ও আবার ভবনের ভেতরে চলে গেলো। ওর কোচিং ছিল সেজন্য…আমি গেট থেকে বের হওয়ার আগেই খুব জোরে শব্দ শুনতে পাই। পেছন ফিরে দেখি, আগুন আর আগুন। সবাই চিল্লাচিল্লি করছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই স্যাররা আমাদের নিষেধ করলো।’
আগুন, কান্নার রোল, চিৎকারের মাঝেও বন্ধুর মুখটা চোখে ভাসছিল জানিয়ে আরিয়ান নাফিজ বলে, ‘ওই সময় আমার শুধু আরিয়ানের (মাহিত হাসান আরিয়ান) কথা মনে পড়ছিল। ভয়ে আমি দৌড়ে বেরিয়ে গোলচত্বরে (দিয়াবাড়ি) চলে যায়। কিন্তু বারবার মনে পড়ছিল ওর কথা।’
‘পরে শুনলাম ও বেঁচে আছে। আমি খুব দোয়া করছিলাম। কিন্তু পরদিন দুপুরে টিভিতে খবরে দেখি আমার বন্ধু আরিয়ান মারা গেছে। ঘুমালে আমি ওকে স্বপ্নে দেখি। দেখি যে, ওর সঙ্গে খেলছি, ওর সঙ্গে টিফিন খাচ্ছি, ওর সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। কিন্তু বাস্তবে তো ও আর নেই।’
আরিয়ান নাফিজ বলে, ‘প্লেন ক্রাশ করার পর একদিন স্কুলে আসছিলাম আম্মুর সঙ্গে। সেদিন শুধু ওর কথাই মনে পড়ছিল। গত সপ্তাহ থেকে নিয়মিত স্কুলে আসছি, দুই-তিনটা করে ক্লাস হচ্ছে। প্রতিদিন গেট দিয়ে ঢুকে ক্লাসে যাওয়ার সময় এখানে এসে আরিয়ানকে দেখি, ছুটির পরও ওকে দেখি। টিফিনে মনে হয়, হঠাৎ আরিয়ান যদি এসে আমার টিফিন বক্স নিয়ে যদি দৌড় দিতো, তাহলে আর রাগ করতাম না।’
মাহিত হাসান আরিয়ানের আরেক বন্ধু হামিম। সে ক্লাসে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত। হামিম বলে, ‘আরিয়ান মাঝেমধ্যে মিসের বকা খেতো। সেজন্য আমি ওকে পড়া বুঝিয়ে দিতাম। বলতাম এভাবে পড়ো। ও চেষ্টাও করতো। আরিয়ানের কথা মনে পড়লে আমার শুধু কান্না পায়।’
গত ২১ জুলাই দুপুর ১টার পরপরই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ির স্থায়ী ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে এ পর্যন্ত ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিত হাসান আরিয়ান একজন। আরিয়ান বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দিয়াবাড়ির তারারটেক এলাকায় বসবাস করতো।
ঘটনার দিন স্কুল ছুটির পর সে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেসময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে গুরুতর আহত হয়। পরদিন ২২ জুলাই দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
তার সঙ্গে মারা যায় তার আরও দুই বন্ধু মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বাপ্পি ও হুমায়ের। বাপ্পি, হুমায়ের ও মাহিত হাসান আরিয়ানের বাড়ি একই জায়গায়। তারা একসঙ্গে স্কুলে আসতো, একসঙ্গে ফিরতো। মৃত্যুর পর তাদের দাফনও করা হয়েছে পাশাপাশি তিনটি কবরে।
এএএইচ/ইএ/জিকেএস