আমি অরিও, পার্শিয়ান ক্যাট ছিলাম। শখের বসে কোনো এক পরিবার আমাকে নিয়েছিল। একসময় আমার ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দেয়। তাই তারা আমাকে ঘরে আর রাখেনি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিল। ঘরে পালা বিড়াল আমি, কী করে রাস্তায় থাকি বলো? না আছে খাবার, না আছে পানি। আমি ক্ষুধায় বালু খেয়েছি। একদিন এক অ্যাঞ্জেল স্টুডেন্ট মা ক্লাস শেষে আসার সময় আমাকে দেখে। আমি তার দিকে করুণভাবে তাকাই। সে আমাকে কোলে তুলে নেয়, পাশেই একটা ভেট দেখিয়ে এক মাসের একগাদা ওষুধ নিয়ে আমাকে ভয়ে ভয়ে বাসায় নিয়ে আসে। ভয়ের কারণ, বাসায় তাদের অনেক বিড়াল আর তোমরা তো জানো, ফাঙ্গাল ইনফেকশন খুবই ছোঁয়াচে। আমাকে একটা ছোট বারান্দায় রাখা হয়েছিল আলাদা করে—খাবার, পানি আর বিছানা দিয়ে। প্রথম দিন এসে আমি তিন ঘণ্টা শুধু খেয়েছি। কারণ, আমার যে পেটে অনেক ক্ষুধা ছিল। আমি দেখছিলাম মা আর বড় আম্মা আমার খাওয়া দেখে চোখে জল ফেলছে।
আমি দেখতাম, সবাই হাঁটাহাঁটি করত ঘরের মধ্যে, অন্য বিড়ালরা ছোটাছুটি করত কিন্তু আমি ওই বারান্দা ছেড়ে ঘরে আসতে পারিনি। মা সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘আমার অরিও তুমি ভালো হলে ঘরে নিয়ে আসব, তুমিও খেলবে।’ আমাকে প্রতিদিন তিনবার মেডিসিন খাওয়াতে হতো, গায়ে ওষুধ মাখাতে হতো, প্রতিদিন স্পেশাল শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতে হতো। তখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে আমার মায়ের। তাও মা ইউনিভার্সিটি থেকে এসেই আমাকে নিয়ে সেবাযত্নে ব্যস্ত হয়ে যেত। মায়ের হাতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়ে গেল কিন্তু তাও মা মন খারাপ করল না, আমার সেবা কমায়নি। ঘরের সাতটা বিড়াল আমার দ্বারা ফাঙ্গাল ইনফেকটেড হলো। সবাইকে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হলো নতুন করে। তাও দেখতাম মা আর বড়মা আশা করত আমি ভালো হব, সুন্দর হব। ২৭ দিনের দিন আমি মোটামুটি ভালো হলাম। আমাকে ঘরে নিল। আমি সারা ঘর ছুটে বেড়ালাম, খেলাম, স্বাধীনতার স্বাদ পেলাম, বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম। ২৯ দিনের দিন আমার কী হলো জানি না, সারা গায়ে পচন ধরল, আসলে আমার ইনফেকশন ভেতরে ছড়িয়ে গিয়েছিল, সুখ কপালে সইল না। দুর্গন্ধ ছড়াত আমার শরীর থেকে। আমার চামড়া খুলে পড়ছিল, যেখানে বসতাম, সে জায়গাও নোংরা হয়ে যেত; তাও তারা আমাকে এতটুকু অবহেলা করেনি। কোলে নিত, গোসল করাত। ৩০ দিনের দিন আমি খাওয়া বন্ধ করলাম। ৩১ দিনের দিন আমার আর শরীর চলছিল না। তবুও আমার যত্ন কমায়নি, ভেটের সঙ্গে আলাপ করে ওষুধ খাওয়াচ্ছিল। আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল, যারা আমাকে ফেলে দিয়েছিল, মায়া করেনি কিন্তু এ স্টুডেন্ট মা-টা আমাকে এত যত্ন করেছে, আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সারা জীবন তার সঙ্গে কাটিয়ে দিই আমি। আমার সুন্দর রূপ নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াই আর বলি—‘দেখো মা, তোমার কষ্ট সার্থক; আমি সুস্থ হয়েছি।’ কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না। হয়তো আমি রাতেই মরে যেতে পারতাম কিন্তু আমি মা ঘুম থেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, মায়ের কোলে উঠব, মাকে দেখব তারপর দুনিয়া ছেড়ে যাব। মাকে না বলে কীভাবে বিদায় নিই বলো? মা ঘুম থেকে উঠল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে পচা গন্ধযুক্ত শরীরটা নিয়ে নিজে গিয়ে মায়ের কোলে উঠলাম, মা কেঁদে জড়িয়ে নিল বুকে, মায়ের দিকে তাকালাম কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসিমুখে দুনিয়া ছেড়ে স্বর্গে চলে আসলাম। আমি দেখলাম, মা হাউমাউ করে অরিও অরিও করে কাঁদছে আর বলছে—‘অরিও তোকে অনেক ভালোবাসি, কেন ছেড়ে গেলি? তোকে তো একটা সুন্দর জীবন দিতে চেয়েছিলাম, বোঝাতে চেয়েছিলাম সবাই ফেলে দেয় না, কেউ বুকে টেনে নেয়।’
মা আমাকে কবর দিয়েছে, রাস্তায় ফেলেনি। এখন আর আমার কষ্ট নেই জানো। কারণ, আমি স্বর্গে আছি। কষ্ট শুধু একটাই, সেটা ওই মায়ের জন্য যে বুকভরা আশা নিয়ে ৩১ দিন-রাত আমার প্রচুর সেবা করেছে। কিন্তু মাকে আমি আমার সুন্দর রূপের চেহারাটা উপহার দিতে পারলাম না, বলতে পারলাম না—‘মা, আমি তোমার ভালোবাসার কাছে ঋণী।’
যদি আমার মালিক আমাকে রাস্তায় ফেলে না দিত, শুরুতেই ট্রিটমেন্ট করত, হয়তো আমি বেঁচে যেতাম। ধিক্কার জানাই ওই মানুষরূপী পশুদের যারা আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল আর ভালোবাসা জানাই আমার সত্যিকারের অ্যাঞ্জেল মাকে, যে ৩১ দিন আমাকে সন্তান করে নিয়েছিল, ভুলিয়ে দিয়েছিল সব কষ্ট, বুঝিয়ে দিয়েছিল—‘তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমি আছি। মন খারাপ করো না অরিও, আমি আছি তো তোমার পাশে…
মা, আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি। তুমি যখন আসবে কোনো একদিন, আমি তোমাকে প্রাণভরে আদর করব, ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব।
পোষ্যকে হারানোর কষ্টে অরিওর হয়েই কথাগুলো বলেছেন নারুটো অ্যান্ড ফ্যামিলির স্বত্বাধিকারী সেহেলী শিমুল