স্যার, গল্পটা থেমে গেলো

1 month ago 17

শ্রদ্ধাস্পদ স্যার, 'সংশপ্তক' আমাদের যতীন স্যার-এর (যতীন সরকার ) চির প্রস্থান ঘটলো । আমরা জানি 'সংশপ্তক' শব্দটি বাংলা ভাষায় একটি বিশেষ্য পদ, যার অর্থ হলো 'যারা মরণপণ লড়াই করেন'। স্যার তো তাই করেছেন দেশের জন্য, সমাজের জন্য, আমাদের জন্য। বাম ধারার চিন্তাবিদ, মনীষা, জীবনযোদ্ধা যতীন স্যারকে তাই বিদায় বলছি না, বলছি প্রস্থান। সংশপ্তকদের বিদায় বলা বাঞ্ছনীয় নয় বলে মনে করি। আমরা জানি, যতীন স্যার-এর জীবনটাই সংশপ্তকের। তাঁর বিদায় নেই। তাঁর অমূল্য গ্রন্থাদি আমাদের পরম সম্পদ। ১৩ আগস্ট অপরাহ্নে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর চির প্রস্থান ঘটে।আর মাত্র ৫ দিন পর ছিল স্যারের নব্বইতম জন্মদিন।

গত জুন মাসে ঢাকার একটি হাসপাতালে স্যার-এর দেহে অস্ত্রোপচার হয়। এর পর থেকে বেশিরভাগ সময় তাঁর কেটেছে হাসপাতালে। আমরা এও তো জানি, সুদীর্ঘকাল ধরে মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্যার এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমাদের গান্ডীব (অর্জুনের ঐশ্বরিক ধনুক) হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য ভূমিকা প্রগতিবাদী ও সচেতন কার না জানা।

যতীন স্যারের জীবনপঞ্জি কিংবা তাঁর জীবনের খতিয়ান কত পুষ্ট বা দীর্ঘ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নুতন করে নিষ্প্রয়োজন। বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্তবাতায়নসহ তাঁর অনেক গ্রন্থ নিশ্চিতভাবে আমাদের পরম সম্পদ। সেই সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেছেন আরও অনেক গ্রন্থ। 'সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র' নামে তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি।

যতীন স্যারের জীবনপঞ্জি কিংবা তাঁর জীবনের খতিয়ান কত পুষ্ট বা দীর্ঘ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নুতন করে নিষ্প্রয়োজন। বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্তবাতায়নসহ তাঁর অনেক গ্রন্থ নিশ্চিতভাবে আমাদের পরম সম্পদ। সেই সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেছেন আরও অনেক গ্রন্থ।

যতীন সরকারের খাতির সীমানা অনেক বিস্তৃত। তিনি আমাদের অকৈতব ( অর্থাৎ সত্য, অকপট, অকৃত্রিম )। লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক এবং ২০০৫ সালে 'পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন' গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর অর্জনের ঝুলি পরিপূর্ণ। তাঁর জন্যই আমরা তাঁর কাছে হয়ে আছি চিরঋণী। যতীন সরকাররা যুগে যুগে জন্মান না। তারা সমাজের আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছেন কিংবা আসেন। অনস্বীকার্য যে , আমাদের সমাজ ও জাতীয় ইতিহাসে ক্রমান্বয়ে এমন 'সংশপ্তক'কে আমরা পেয়েছি। তেমনই একজন 'সংশপ্তক' যতীন স্যার। তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি আমাদের নিশ্চয় পীড়িত করছে, কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে জেগে আছেন এবং নিশ্চয় থাকবেন তাঁর সমৃদ্ধ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।

পেশাগত প্রয়োজন ও স্বার্থে তাঁর দ্বারস্থ হয়েছি বারবার। আমার খুব মনে আছে দুহাজার তেইশ সালের শেষের দিকে তেমনই প্রয়োজন ও স্বার্থে একদিন মধ্যাহ্নে স্যারকে ফোন করলাম। স্যার ফোনের ওপ্রান্ত থেকে অট্টহাসি দিয়ে বললেন, 'এবার ছুটি দাও। কাজের প্রয়োজনে আর জ্বালিয়েও না, গল্পের জন্য ফোন করো; বারবার করো। এখন শুধু গল্প করতে ইচ্ছা করে। গল্পের জন্য ফোন করো।' এরপর যতবার স্যারকে ফোন করেছি গল্পের ছলেই করেছি কিন্তু এরই ফাঁকে নিজের পেশাগত স্বার্থও হাসিল করেছি। যতীন স্যারের সঙ্গে গল্প করা মানেই নিজেকে সমৃদ্ধ করার অপার সুযোগ পাওয়া। স্যার, এই অনুতাপ কোথায় রাখি গল্পটা যে আজ চিরদিনের মতো থেমে গেলো। আমরা এ সত্যও জানি, জীবন আর মৃত্যু আলাদা নয়; যেমন সব নদী একদিন সমুদ্রে গিয়ে মেশে, তেমনই আমাদের সকলের জীবন একদিন মৃত্যুলোকে গিয়ে এক হবে৷ মৃত্যু অনিবার্য সত্য। একদিন তো মরেই যাব, কিন্তু তা জেনেও নিজের এবং প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার জন্য আকুতি প্রতিটা প্রাণেই বিদ্যমান। স্যার, আমরা আরও জানি, জাগতিক নিয়মেই জীবন-গল্পও একসময় না একসময় থেমে যায় এবং যাবেও এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্যার, আক্ষেপও তো জীবনেরই অনুষঙ্গ যা উপেক্ষা করা যেকোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে দুরূহ, একেবারে দুরূহ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'মৃত্যু পরে' কবিতায় বলেছেন, 'আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুলভ্রান্তি, সব গেছে চুকে।/ রাত্রিদিন ধুক ধুক, তরঙ্গিত দুঃখসুখ, থামিয়াছে বুকে। / যত কিছু ভালোমন্দ, যত কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব, কিছু আর নাই। / বলো শান্তি, বলো শান্তি, দেহ সাথে সব ক্লান্তি, হয়ে যাক ছাই...'।

একটানা চার দশকের বেশি সময় অধ্যাপনা করে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পর যতীন সরকার স্ত্রী কানন সরকারকে নিয়ে শিকড়ের টানে চলে যান নিজ জেলা নেত্রকোনায়। সঙ্গে ছেলে ছেলে সুমন সরকার, মেয়ে সুদীপ্তা সরকার। নেত্রকোনা শহরের সাতপাই এলাকার নিজ বাড়িতেই থাকতেন। আমরা অনেকেই স্যার-এর কাছ থেকে কিছু না কিছু কুড়িয়ে নিতে সেখানেও ছুটে গেছি বারবার। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অনেকেরেই চরিত্র এতো নির্মল যে তার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলেও মনে হয় কিছুই বলা হয়নি। অর্থ কিংবা টাকাই অধিকাংশ মানুষের একমাত্র ইন্দ্রিয় হলেও যতীন স্যাররা এর ব্যাতিক্রম বলেই এ সমাজে অনেকেই তাদের কল্যাণে নিরাশ্রয়ী গৃহী হয়েও একেবারে অবলম্বনহীন নন।

শিক্ষাবিদ, চিন্তক, প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বাঙালি বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর অমূল্য সৃষ্টির জন্য। ‘প্রবন্ধ’ শব্দটির অর্থ প্রকৃতরূপে বন্ধন। যুক্তি-আশ্রয়ী চিন্তাগুলোর মধ্যে যখন প্রকৃত বন্ধন রচিত হয়, তখন তা প্রবন্ধে রূপান্তরিত হয়। মননশীল সাহিত্যের প্রধান শাখা প্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্যে মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন মননশীল প্রাবন্ধিক দুর্লভ এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। সেই দুর্লভ প্রাবন্ধিকদের অন্যতম একজন আমাদের যতীন স্যার, যতীন সরকার। তিনি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছেন সুচারুরূপে। এ যেন মালা গাঁথার গল্পের মতো গল্প এবং শেষ পর্যন্ত তা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। যতীন সরকারের মৌলিক ও সাহসী প্রয়াস পরিস্ফুটিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য রচনায়। সংস্কৃতির প্রকৃত রূপের সঙ্গে পাঠক সাধারণকে সংযুক্ত করা নিশ্চয় যতীন সরকারে বিশেষ অবদান। প্রাজ্ঞের প্রয়াণ দেহত্যাগমাত্র- তা চিরসত্য মনে করি। তিমিরবিনাশী মশাল যারা জালান তারা অবশ্যই চিরপ্রণম্য প্রাজ্ঞজন। যতীন সরকার এরই এক স্মারক।

সময়ের অগ্রজ চিন্তাবিদ যতীন সরকার ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি বেঁচে নেই, জীবিত আছি '। তাঁর এই পাঁচটি শব্দের এ বাক্যর মর্মার্থ সময়ের প্রেক্ষাপটে কতটা গভীর ছিল এরও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। তবুও একদিন স্যার-এর সঙ্গে গল্পে তাঁর এ কথার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলাম। স্যার বলেছিলেন , "একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছিলেন 'রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন বেঁচে ছিলেন'। বেঁচে থাকা আর জীবিত থাকা এক কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর বেঁচে মারা গেছেন কিন্তু, তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মানে সক্রিয় ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন। আর আমার ৮৬ বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে আমি বেঁচে নেই জীবিত আছি মাত্র , সেটাই বলতে চেয়েছি। "ওই সাক্ষাৎকারেই তিনি আরও বলেছিলেন , "আমি জানি যারা কেন্দ্রে থাকেন তারা নিজেকে অনেক বড় মনে করেন। অনেক সুযোগ-সুবিধে পান। আমি সেগুলো পাই না। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি প্রান্তিক অবস্থানে থাকি। আমি গাঁয়ের মানুষ। আমি নিজেকে 'গাঁইয়া' বলি এবং অনেকে আমাকে 'গাঁইয়া' বলেন। তবে আমি গ্রাম্য না। গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট না। আমি গাঁয়ের মানুষ হিসেবে যা দেখেছি এই 'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন' কিংবা আমি যা দেখেছি তা যদি আমি ঢাকায় থাকতাম তাহলে এগুলো লিখতে পারতাম না। আমি প্রান্তে থেকে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। ভালো আছি।" স্যারের এ উপলব্ধি মোটেও অমূলক নয়।

সাঁকো বাঁধার কাজটি দেশজ সংস্কৃতির পুনরাবিস্কারের মধ্যে সাধন করা সম্ভব বলে যতীন স্যার বরাবরই ভেবেছেন। তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর আফ্রিকার কবিতাবিষয়ক 'আফ্রিকার কবিতা পাঠের ভাবনা :বাংলার কবির কাছে প্রত্যাশা' শীর্ষক রচনায়। এই প্রেক্ষাপটেই তিনি আমাদের কবিতাকেও দেশজ-ঐতিহ্য সংলগ্ন দেখতে চেয়েছেন । কবি সুনির্মল বসু একটি শিশুতোষ কবিতায় লিখেন : ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র/ নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।’ এই কাব্যোক্তি কেবল শিশুদের জন্য নয়, বড়দের বোধোদয়ের জন্যও প্রযোজ্য। বিশ্বখ্যাত রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘পৃথিবীর পাঠশালা’। সমগ্র বিশ্বজগৎকেই তিনি শিক্ষালয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের যতীন স্যারও তেমনটিই ভেবেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতই বিদ্যাব্রতী। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় ‘শ্রীজ্ঞান’ যতীন সরকার। একই জেলার মানুষ যতীন স্যার ও গুণদা। গুণদা যতীন স্যার-এর সরাসরি ছাত্র বলেই হয়তো স্যারকে তাঁর অধিক পাঠ করার সুযোগ হয়েছে এবং তিনি বলতে পেরেছেন ‘শ্রীজ্ঞান’ যতীন সরকার। আর আমরা যতীন স্যার-এর গল্পের ছাত্র। কিন্তু সেই গল্পের সেতু ভেঙে গেলো ১৩ অগাস্ট অপরাহ্নে।

স্যার, প্রণাম। চির প্রণম্য স্যার, আপনি আমাদের বাতিঘর বাতিঘর বা লাইট হাউজ হয়েই থাকবেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article