মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান (রহ.)
অনুবাদ: মওলবি আশরাফ
হজ এমন এক ইবাদত—যার মাধ্যমে একজন মুমিন নিজের ইমান নবায়ন করে। হজের আগের ইমান যেন এক প্রাথমিক প্রস্তুতি, যা পরিপূর্ণ রূপ পায় তখন, যখন সে কাবা প্রাঙ্গণে তাওয়াফ করার সময় সবার সাথে গলা মিলিয়ে পাঠ করে—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ সেই সময় সে আর কেবল মুখে ইমানের কথা বলে না, বরং সরাসরি আল্লাহর দরবারে গিয়ে নিজের আনুগত্য পেশ করে।
এই নবায়নেরই স্বীকৃতি হলো—গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়া। যেমন কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সকল পাপ মাফ হয়ে যায়, তেমন হজ আদায় করলেও তার অতীত জীবনের গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। হজ হচ্ছে ইমানের সেই দ্বিতীয় ধাপ, যার পর একজন মুমিনের আত্মিক পূর্ণতা লাভ করে। প্রথম ধাপ হলো জ্ঞান ও উপলব্ধির ভিত্তিতে ইমান গ্রহণ; আর দ্বিতীয় ধাপ হলো আমল ও আত্মত্যাগের ভিত্তিতে ইমানকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। প্রথম ইমান যদি হয় বিশ্বাসের সূচনা, তাহলে দ্বিতীয় ইমান সেই বিশ্বাসের পরিণতি। প্রথমটি যদি হয় পরোক্ষ ইমান, তাহলে দ্বিতীয়টি হলো প্রত্যক্ষ ইমান।
তবে এই দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছাতে হলে দরকার সামর্থ্য। শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ আদায় না করে মৃত্যুবরণ করে—তার ব্যাপারে হাদিসে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। রসুলে পাক (সা.) বলেন,
من ملَك زادًا وراحلةً تُبِلِّغُه إلى بيتِ اللهِ، ولم يحجَّ؛ فلا عليه أن يموتَ يهوديًّا أو نصرانيًّا
অর্থ: যার হজে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে, তবু সে হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহর কাছে তার কোনো মূল্য নেই, চাই সে ইহুদি হয়ে মরুক কিংবা খ্রিস্টান হয়ে। (সুনানে তিরমিজি: ৮১২) এ কথার মানে হলো—যে আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয় না, আল্লাহও তার প্রতি উদাসীন থাকেন।
আসলে ইসলামের প্রকৃত অর্থ হলো নিজের অস্তিত্ব আল্লাহর হাতে তুলে দেওয়া। হজ সেই আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত প্রকাশ। আরাফার ময়দানে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ সমস্বরে বলে—‘আমি উপস্থিত, হে আল্লাহ, আমি উপস্থিত!’—তখন তা শুধু ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং গোটা উম্মাহর একত্রে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার ঘোষণা। হজ যেন একটি মহাসমাবেশ—যেখানে সব জাতি, সব ভাষা, সব বর্ণ এক কাতারে এসে দাঁড়ায় শুধু রবের সন্তুষ্টির আশায়।
আর এই ‘উপস্থিতি’ কেবল হজের নয়, বরং কেয়ামতের একটি পূর্বাভাস। সেদিনও মানুষ আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। কিন্তু হজের সময় মানুষ স্বেচ্ছায়, ভালোবাসা ও তওবার সাথে নিজেকে সেই দরবারে হাজির করে।
সত্যি বলতে, হজ সমস্ত ইবাদতের সর্দার। যেমন কাবা সকল মসজিদের কেন্দ্র, তেমনই হজ হলো সকল ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু। হজে আছে নামাজের খুশু, রমজানের রোজার সংযম, জাকাতের উদারতা, এবং কালেমার দৃঢ়তা—সবকিছু একত্রে, এক সময়ে, এক স্থানে, একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
লেখক: বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ
ওএফএফ/এমএস