অবস্থানগত কারণে ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ নামটি শুনলেই রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশেও রয়েছে এমন এক ‘ট্রায়াঙ্গল’, যেখানে কোনো রহস্য নেই বরং রয়েছে এক অদ্ভুত ভৌগোলিক বিস্ময়! এখানে এক অনন্য মিলনমেলায় একত্র হয়েছে বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার সীমান্ত। মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথেই পর্যটকেরা তিনটি জেলা ঘুরে দেখতে পারেন। স্থানীয় ও পর্যটন উদ্যোক্তাদের মতে, পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে এই স্থানটি হয়ে উঠতে পারে পর্যটকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এই তিনটি স্থানকে বিভক্ত ও সংযুক্ত করেছে ছোট্ট হলতা নদী। বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের লক্ষীপুরা গ্রাম, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের দেবত্র গ্রাম এবং ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার পাতাকাটা ইউনিয়নের জোরখালি গ্রাম- এই তিনটি স্থানের সীমান্ত এসে মিশেছে এই হলতা নদীর বুকেই।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বরগুনার লক্ষ্মীপুরা খালের সেতু পার হলেই পিরোজপুরের দাউদখালী ইউনিয়ন। এখান থেকে হলতা নদীর পাড় ধরে ২ মিনিট হেঁটে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ঝালকাঠির জোরখালি গ্রামে। হলতা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে রাজারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাজারহাট শহীদ বাচ্চু মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় দুটি হলতা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় স্কুলের সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই শুরু হয়েছে বরগুনার বামনা উপজেলা ও ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার সীমানা। এসব বিদ্যালয়ে তিন জেলার শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে। তাদের বন্ধুত্ব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষার পাশাপাশি গড়ে উঠছে সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন।
রাজারহাট বিদ্যালয়ের তিসা নামের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে জানায়, এই স্কুলে পড়তে আমার অনেক ভালো লাগে। আমাদের স্কুলটি তিন জেলার মোহনায় হাওয়ায় এখানে আমার বান্ধবীরা সব অন্যান্য জেলার। আমি তাদের জেলার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি। বাংলাদেশে অসংখ্য স্কুল আছে, কিন্তু আমাদের এই স্কুলের মতো আর কোনো স্কুল নেই যেখানে তিন জেলার মানুষ এক স্কুলে পড়ে।
ঝালকাঠি জেলার বাসিন্দা সোয়েব আল নাইম শুভ পর্যটকদের আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এই জায়গাটি এমন একটি জায়গা যেখানে তিনটি জেলা মিলেছে। এখানে আমরা সবাই এমনভাবে বাস করি যেন সবাই এক জেলারই মানুষ। কাগজপত্রে শুধু আমরা আলাদা। এই জায়গাটা এত সুন্দর আপনি আসলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এখানে আপনি ৫ মিনিট হেঁটে তিনটি জেলায় ঘুরে আসতে পারবেন। এখানকার নদী ও তীরবর্তী জঙ্গলগুলো অনেক মনোমুগ্ধকর। তিন জেলার কথা শুনে অনেকেই এখন আমাদের এই এলাকায় ঘুরতে আসেন।
সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা সবুজ খান সাগর জাগো নিউজকে বলেন, হলতা নদী আমাদের তিনটি জেলাকে বিভক্ত করেছে, এই এলাকায় বাস করে আমাদের খুব গর্ব হয়। কারণ আমরা তিনটা আলাদা জেলার হলেও আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন এক। এই তিন এলাকার সবাই ঐতিহ্যবাহী রাজারহাট বাজারে আসে, আড্ডা দেয়, বাজার করে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে একে অপরের এলাকায় গেলেও আমাদের মনে হয় না যে আমরা অন্য একটি জেলায় এসেছি। আমরা সবাই মিলেমিশে চলি।
তিনি বলেন, আমাদের এই তিনটি জেলার বন্ধন অটুট রাখতে সরকার যেন এখানে সুদৃষ্টি দেয়। পাশাপাশি এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আবেদন জানাই।
তিন জেলার শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা রাজারহাট শহীদ বাচ্চু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহির খান জাগো নিউজকে বলেন, আমার এই স্কুলে তিন জেলার ও তিন ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। এটা আমাদের কাছেও খুব আনন্দের। সবচাইতে বড় বিষয়, তিন জেলার সংস্কৃতি আলাদা হলেও সবাই মিলেমিশে পড়াশোনা করে তাদের আলাদা সংস্কৃতি ভাগ করে নেয়। এছাড়া আমার স্কুলটি সীমানা ঘেঁষে হওয়ায় এই তিন এলাকায় আমার স্কুলটি শিক্ষায় যেমন স্বনামধন্য এবং একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এ বিষয়ে বরগুনা পর্যটন উদ্যোক্তা উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ খান জাগো নিউজকে বলেন, এলাকাটি পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময়। এছাড়া বরগুনার বুকআপনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সাবসেক্টরের হেড অফিস ছিল। এখানে দাঁড়িয়ে তিনটি জেলা দেখা যায়। এখানে একটি স্কুল আছে যেখানে তিনটি উপজেলার শিক্ষার্থীরা পড়ে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে আমরা সেখানে পর্যটন উদ্যোক্তা কমিটির পক্ষ থেকে ক্যাফে বা ছোট দর্শনীয় স্থানের মতো উদ্যোগ নিতে পারি যা স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এফএ/এমএস