হাঁস কেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকে?

3 weeks ago 8

তানজিদ শুভ্র

বাড়ির পাশে পুকুরের পানিতে ভাসমান কয়েকটি হাঁস দেখে মনে হয়, যেন তাদের দুনিয়ায় কোনো ঝামেলা নেই। মাথা উঁচু করে ভেসে থাকা, মাঝেমধ্যে ঠোঁট দিয়ে পালক ঠিক করা কিংবা দলবেঁধে সাঁতার কাটার দৃশ্য—সবই প্রকৃতির এক প্রশান্ত ছবি। বাড়ির পাশে কোনো ছোট নদী থাকলে সেখানেও মেলে এমন দৃশ্য।

পানির সঙ্গে হাঁসের বন্ধুত্ব জন্মগত। তাদের শরীরের গঠনই এমন। তারা সহজে ভেজে না, ডোবে না। পানিতে দারুণভাবে ভেসে থাকতে পারে। হাঁসের লেজের কাছে একটি ছোট্ট তেলগ্রন্থি থাকে। হাঁস নিয়মিত ঠোঁট দিয়ে পালক আঁচড়ে তেল সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়। ফলে পালকের ওপর জল প্রতিরোধী স্তর তৈরি হয়। ফলে হাঁস ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকলেও তাদের শরীর ভেজে না। আরেকটি বিশেষ গুণ হলো তাদের ওয়েবড পা। আঙুলের ফাঁকে পাতলা চামড়ার ঝিল্লি থাকায় হাঁসের পা পানিকে প্যাডেলের মতো ঠেলে দেয়। এতে তারা খুব দ্রুত ও সহজে সাঁতার কাটতে পারে। পানির নিচে ডুব দিয়ে খাবার খোঁজার সময়ও এই পা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে বর্ষা আর শীত মিলিয়ে হাঁসের জগৎ হয়ে ওঠে আরও রঙিন। বাংলাদেশে শীত এলে আকাশে দেখা মেলে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির। এদের মধ্যে শীতের শুরুতেই সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া বা চীনের দূর জলাভূমি থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী হাঁস দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে হাওর-বাঁওড়, নদী কিংবা সুন্দরবনে এসে হাজির হয়। কেউ কেউ ৪-৫ হাজার কিলোমিটারও উড়ে আসে। এ ভ্রমণ শুধু আবাস পরিবর্তনের জন্য নয়, শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচা, খাবারের সন্ধান পাওয়া এবং প্রজননের চক্র পূর্ণ করার জন্যও তারা ভ্রমণ করে।

পরিযায়ী হাঁসের এ যাত্রা প্রকৃতির এক বিস্ময়। তারা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে উড়ে আসে। পথে কয়েকটি বিরতি নেয়। বছর বছর একই জায়গায় ফিরে আসে। সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, সুন্দরবনের জলাভূমি কিংবা কক্সবাজারের উপকূলে এদের দেখা মেলে। দেশের অনেক অঞ্চলে হাঁসের মাংস ও ডিম বিশেষ জনপ্রিয়। বিশেষ করে শীতকালে হাঁসের মাংস ও আলুসহ রান্না অন্যরকম স্বাদ এনে দেয়। হাঁসের ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে বড় ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট অঞ্চলে হাঁসের ডিমের ভর্তা বা হাঁসের মাংসের ঝোল বিশেষ খাবার হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে হাঁস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাঁস পালন তুলনামূলক কম খরচে সম্ভব এবং ডিম-মাংস বিক্রি করে পরিবারে বাড়তি আয় করা যায়। বন্যার সময়ও হাঁস খাবার খুঁজে নিতে পারে। তাই অনেক অঞ্চলে এটি মুরগির চেয়ে বেশি লাভজনক। হাঁস শুধু খাদ্য চাহিদা মেটায় না। প্রকৃতির পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও অবদান রাখে। জলাশয়ের শৈবাল ও পোকামাকড় খেয়ে পানির মান বজায় রাখে, বীজ বিস্তারে সাহায্য করে এবং জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে অসংখ্য প্রাণীর বেঁচে থাকার সহায়ক হয়।

জেনে রাখা ভালো, হাঁস নিজের ঘাড় প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিতে পারে। ঘুমানোর সময় মস্তিষ্কের একপাশ জাগ্রত রেখে অন্যপাশ বিশ্রাম নেয়। যাতে বিপদ এলে দ্রুত সাড়া দিতে পারে। হাঁসের চোখে বিশেষ একধরনের ফিল্টার থাকে, যা পানির নিচে স্পষ্ট দেখতে সাহায্য করে। অনেকের ধারণা, হাঁসের ডাকের কোনো প্রতিধ্বনি হয় না। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত, এটি আসলে এক ধরনের মিথ। প্রতিধ্বনি হয়, শুধু কম শোনা যায়।

তবে হাঁসকে শুধু পুকুরে ভাসমান শান্ত পাখি ভাবা ঠিক হবে না। তারা সর্বত্র সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যখন কোনো হাঁসকে ধীর ভঙ্গিতে সাঁতরাতে দেখবেন, মনে রাখবেন, এরা শুধু পানির ঢেউ কেটে এগোয় না, ইতিহাসের সঙ্গেও ভেসে বেড়ায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর।

এসইউ/

Read Entire Article