হাতিয়ার দুঃখ নদীভাঙন; জনপদ বিলীনে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

1 month ago 9

নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের বড় দুঃখ নদীভাঙন। মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে প্রতি বছর ভেঙে পড়ছে বসতঘর, ফসলি জমি, স্কুল, মসজিদ, কবরস্থান, বড় বড় দালানসহ হাটবাজার। বছরের পর বছর ধরে চলা এ ভাঙন হাতিয়ার মানুষকে করেছে নিঃস্ব ও গৃহহীন।

নদীর করাল গ্রাসে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রয়েছে নদীপাড়ের হাজার হাজার পরিবার। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশার বাণী শোনালেও এখন পর্যন্ত হয়নি এর স্থায়ী কোনো সমাধান।

হাতিয়ার হরনী, চানন্দী, সুখচর, নলচিরা, চরঈশ্বর ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের মানুষ এ ভাঙনের সবচেয়ে বড় শিকার। স্বাধীনতার পর থেকে বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি ভবন, ঐতিহ্যবাহী হাটবাজার নদীতে বিলীন হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভাঙতে থাকায় এরই মধ্যে বসতভিটে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করেও রক্ষা হয়নি নিজেদের বসতি। নতুন করে ঘর গড়ার স্বপ্ন দেখার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছে অনেকেই।

সরেজমিন চরইশ্বর ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকায় দেখা গেছে, নিজের ভিটেমাটি হারিয়ে নদীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। মিনমিন করে কী যেন বলছেন। পাশে নিজেদের খালি ভিটায় পায়চারি করছেন পঞ্চাশোর্ধ কয়েকজন নারী। একটু সামনে এগোলেই কথা হয় তাদের একজনের সঙ্গে। 

সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে বাংলাবাজার এলাকায় নদীর ধারে বসবাস করা শোভা রাণী বলেন, ‘বাজি তিনবার অ্যার বাই ভাঙছে। স্বয়-সম্বল বেক আরালাইছি। সাত বছর আগে সাপের কামড়ে স্বামী মইচ্ছে। বাপ-মা ভাই-বোন কেউ নাই। নদী ভাঙতে ভাঙতে শেষমেশ বেগগুন ইন্ডিয়া চলি গেছে। হোলা মাইয়া লই নদীর কুলে থাইকবার অনেক ছিজ্জত করি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘দুগা হোলা সাগরে মাইনসের নৌকাতে মাছ ধরে। সামান্য যা কিছু আনে তা দিয়া কোনোরকম খাই নো খাই দিন কাডাই। কোনানে যে মাথা গুঁজামু হেই ব্যবস্থা নাই। ওগ্যা মাইয়া বিয়ার লাক। এটা অন অ্যার গলার কাঁডা। কি যে করমু কিছুই বুঝতেছি না।’

কথা হয় বৃদ্ধ রবিউল হোসেনের (৬৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় জায়গা-জমি সবই ছিল। বাড়ির সামনে স্কুল-মসজিদ ছিল। সাতবার নদীভাঙনে পড়ে সর্বহারা হয়ে গেছে। এখন নদীর একেবারে ঢালে কোনোরকম বসবাস করছি। জোয়ার এলে ঘরে থাকতে পারি না। এ বর্ষায় বর্তমান ভিটেও টিকবে না। সামর্থ্য নেই যে উপরে কোথাও গিয়ে স্থায়ী একটা ভিটা বাঁধব। অনেক আগ থেকে শুনতেছি এখানে ব্লক বাঁধ হবে; কিন্তু বাস্তবে কোনো খবর নেই। 

নদীর পাড়ে নিজের শূন্য ভিটায় বসে থাকা জাকিয়া খাতুন (৬০) বলেন, ২০ বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছে। নদী চারবার ঘর নিয়ে গেছে। এখন খালি ভিটা পড়ে আছে। কিন্তু সামর্থ্য নাই যে মাথাগোঁজার ঠাঁই নেব। রাত হলে অন্যের ঘরে থাকি। দিন হলে মানুষের বাড়িঘরের কাজ করি, পারলে খাই না পারলে উপোস থাকি। আমাদের কেউ দেখার নাই।

শুধু শোভা রানী বা রবিউল হোসেন আর জাকিয়া খাতুন নয়, তাদের মতো শত শত মানুষ প্রতিবছর নদীতে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন। কোনো সরকারি সহায়তা না পেয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন বাঁধের ধারে, সরকারি খাসজমিতে কিংবা আত্মীয়দের বাড়িতে। 

স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মেঘনার ভাঙন বৃদ্ধি পায়। তবে এ বছর ভাঙনের মাত্রা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বাজারসহ আশপাশের এলাকাও হুমকির মুখে পড়েছে। নদীভাঙন রোধে দীর্ঘদিন ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বারবার দাবি জানানো হলেও স্থায়ী কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।

তারা আরও জানান, নদীভাঙনে শুধু ঘরবাড়ি নয়, হাতিয়ার মানুষ হারাচ্ছেন তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস ফসলি জমি। ফলে কৃষকরা কর্মহীন হয়ে চরম সংকটে পড়ছেন। জেলেরা নদীর ভয়াবহ রূপে মাছ ধরা থেকেও দূরে থাকছেন। গরিব মানুষ প্রতিদিনের খাবার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে, শিক্ষকরা অন্যত্র বদলি হচ্ছেন আর অভিভাবকরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (হাতিয়া) জামিল আহমেদ পাটোয়ারী বলেন, নদীভাঙন রোধে হাতিয়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় জিও ব্যাগ দিয়ে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ঘাট এলাকায় জিও ব্যাগ এবং জিও টিউব দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়েছে। এবারে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী অস্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষা কাজগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে। নদীভাঙন রোধে যতটুকু সম্ভব আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন বলেন, হাতিয়ার নদীভাঙন একটি পুরোনো সমস্যা। এখানে বারবার ভাঙনের কারণ হচ্ছে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও প্রবল জোয়ার-ভাটা হয়। যতদিন স্থায়ীভাবে নদীশাসন ও তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ না হবে, ততদিন এ দুর্ভোগ চলতেই থাকবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি। মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তবে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।

হাতিয়ার নদীভাঙন শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি এখন একটি মানবিক বিপর্যয়। যেভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় এ অঞ্চলের মানুষ যেন রাষ্ট্রের আলো থেকে বঞ্চিত এক নিখোঁজ জনগোষ্ঠী। তাই নদীভাঙন রোধে এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন হাতিয়াবাসী।

Read Entire Article