জয়পুরহাটে খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুরের কারণে বাতিল হওয়া মেয়েদের সেই প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খুব দ্রুত আয়োজিত হবে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) সকালে ইউএনও-ওসিসহ সেনাবাহিনীর একটি দল ওই খেলার মাঠটি পরিদর্শন করেন।
এ সময় খেলা বন্ধের প্রতিবাদকারী এবং বেড়া ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে তারা স্বীকার করেন, সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে ভাঙচুরের ওই ঘটনাটি ঘটে। এই মাঠে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে আর কোনো বাধা দেওয়া হবে না।
সরেজমিনে তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠের মধ্য কয়েকটি ডেকোরেটারের চেয়ার টেবিল ফেলানো রয়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম ও থানার পরিদর্শক (ওসি) আনিছুর রহমান এবং ছাত্রদের প্রতিনিধি মাহফুজ হোসেন। এ সময় গত মঙ্গলবার মাঠের বেড়া ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনকে মাঠে দেখা যায়।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) রাতে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও ও থানার ওসি ঘটনাস্থলে পরিদর্শনের পর ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিপুল কুমারকে আহ্বায়ক করা হয়। এছাড়াও আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ভারপ্রাপ্ত থানার কর্মকর্তা (ওসি,) জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা ও ছাত্র প্রতিনিধি মাহফুজ আহমেদকে সদস্য করা হয়।
এ ছাড়া আক্কেলপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ খেলার মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুর ও খেলা বন্ধের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার নিন্দা জানিয়ে জেলা প্রশাসনকে নারী ফুটবল ম্যাচটি চালুর দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) আফরোজা আকতার চৌধুরী ও পুলিশ সুপার (এসপি) মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম, থানার পরিদর্শক (ওসি) আনিছুর রহমান ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে খেলার মাঠ পরিদর্শন করেন। তারা আশপাশের লোকজন, আয়োজক কমিটি, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও বাচ্চা হাজী কওমি মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিলকপুরের টি স্টার ক্লাবের উদ্যোগে তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে প্রায় দেড় মাস আগে থেকে আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। ক্লাবের সভাপতি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হাসান ইমন কালবেলাকে বলেন, টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচে মাটিতে বসে খেলা দেখার জন্য ৩০ টাকা ও চেয়ার বসে খেলা দেখার জন্য ৭০ টাকা মূল্যের টিকিটের ব্যবস্থা রাখা হয়। টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল পার্বতীপুর ও জয়পুরহাট নারী ফুটবল দল। ফাইনাল ম্যাচের আগে আয়োজক কমিটি ওই মাঠে ৩০ টাকা ও ৭০ টাকা টিকিট জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের প্রীতি ম্যাচের ঘোষণা দিয়ে এলাকায় মাইকিং করে প্রচার করে। তখন থেকেই স্থানীয় মুসল্লিরা বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা করে। এক পর্যায়ে গত মঙ্গলবার বিকেলে একদল মুসল্লি ও মাদ্রাসার ছাত্ররা হামলা চালিয়ে খেলার মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুর করে। ঘটনাটি আবার হামলাকারীদের মধ্য থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে দৃশ্য প্রচার করা হয়। ওই ঘটনার পর আয়োজকরা গত বুধবার বিকেলের প্রীতি নারী ফুটবল ম্যাচটি বাতিল করেন।
জানতে চাইলে বাদশা হাজি মাদ্রাসার নায়েবে মোহতামিমের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন ওই মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষক মোস্তাকিম হোসাইন। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবারে তিলকপুরে নারী ফুটবল খেলা নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে যা হয়েছে তাতে আমরা দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে লজ্জিত। আমরা ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করব না। যেখানে সরকার খেলাকে বৈধতা দিয়েছে সেখানে সরকারে বিরুদ্ধে আমরা আর কখনও যাব না। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আমরা যা করছি এখান থেকে আমরা লজ্জিত, ভবিষ্যতে জয়পুরহাট জেলাতে আর কখনো এই ধরনের কাজ হবে না। আমরা নারী খেলার বিষয়ে মাথা গলাবো না।
ভ্যাটকুরি মসজিদের খতিব ও তিলকপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, গত মঙ্গলবারে তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, আমরা আইনশৃঙ্খলাকে শ্রদ্ধা জানাই। সরকারি নিয়মনীতিতে খেলা হোক এটা আমরাও চাই। আলেম ওলামাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই বিষয়টি ঘটেছে। সামনের দিনে আর যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে আমিও সেটিই চাচ্ছি। সরকারের বিরুদ্ধে আমরা যেতে চাই না।
তিলকপুর পুরাতন বাজার জামে মসজিদের খতিব আব্দুস সামাদ বলেন, খেলার বিরুদ্ধে আমাদের কোন পদক্ষেপ ছিল না। তবে সামান্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ভুল বোঝাবুঝির কারণে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। খেলা উন্মুক্তভাবে চললে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
টি স্টার ক্লাবের সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হাসান ইমন বলেন, তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল একটি ভুল বোঝাবুঝির বিষয়। আমরা আলেম সমাজের সাথে একত্র হয়ে বিষয়টি মীমাংসা করেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম কালবেলাকে বলেন, আমরা সবকিছু মিলিয়ে সমাধানের পথে চলে এসেছি। এখানকার যারা জনগণ তারা সবাই একসাথে হয়েছেন। এখানে আর খেলা পরিচালনা করার জন্য কোন বাধা নেই। খুব দ্রুতই আমরা খেলা পরিচালনা করতে পারব।
আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, তিলকপুর মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে নিয়ে স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খেলাটি বন্ধ হয়েছিল। সেটির প্রায় সমাধান হয়েছে, এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক।