২০১৯ সালে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ। প্রতিষ্ঠার সাড়ে ছয় বছর পরও কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জায়গা ঠিক হয়নি। নেই কোনো একাডেমিক ভবন বা পরীক্ষাগার। নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে কয়েকটি কক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
মেডিকেল কলেজে পাঠদানের জন্য নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষ ও গবেষণাগার সংকটে ক্লিনিক্যাল (হাতে-কলমে) শিক্ষার চরম ঘাটতি নিয়েই শেষ হচ্ছে চিকিৎসকদের পড়াশোনা।
আবাসন ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা মেনে নিয়ে পড়াশোনা করলেও যে সংকট তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে, তা হলো ক্লিনিক্যাল ক্লাস (হাতে-কলমে শিক্ষা) ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক স্বল্পতা। কারো কারো শিক্ষা জীবন পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসার মতো বিদ্যায় হাতে কলমে শিক্ষা খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, মেডিকেলে ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা প্রথম পর্বে দেড় বছর সময়ের মধ্যে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি পড়েন। দ্বিতীয় পর্বে এক বছর সময়ের মধ্যে কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন পড়েন। তৃতীয় পর্বে এক বছরের জন্য ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি পড়েন ও চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্বে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দেড় বছর পড়তে হয় তাদের। এই সময়ের মধ্যে মেডিসিন, কার্ডিওলজি, শিশু, বক্ষব্যাধি, সার্জারি, অর্থোসার্জারি, ইএনটি, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া ও প্রসূতি বিষয়ে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিক ক্লাস করতে হয়।
কিন্তু আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও রোগী কোনোটাই নেই। হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রোপচার কক্ষ, আইসিইউ, সিসিইউ ও এনআইসিইউর ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর সংখ্যাও নগণ্য। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাসও ব্যাহত হচ্ছে। একাডেমিক শিক্ষা জীবন শেষ। ইন্টার্নি শেষ করে চিকিৎসক হচ্ছেন তারা। কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নিয়ে বের হতে হচ্ছে তাদের। অনেক বিষয়ে জানার ঘাটতি নিয়েই শেষ হচ্ছে পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ উদ্বোধন করেন। কলেজের সঙ্গে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ যুক্ত রয়েছে। বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে সদর হাসপাতালের কয়েকটি কোয়ার্টার ব্যবহৃত হচ্ছে। এরপর প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও নিজস্ব ক্যাম্পাস, একাডেমিক ভবন, আবাসনের জন্য এখনো জায়গা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। নতুন এ মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও কোনো অগ্রগতি নেই প্রতিষ্ঠানটির।
স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানটির সূত্র জানিয়েছে, মেডিকেল কলেজের জন্য প্রথমে সদর উপজেলার মৌজে বালি এলাকায় জায়গা নির্বাচন করে জরিপ ও নকশার কাজ করা হয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। পরে নেত্রকোনায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০০ একর জায়গা থেকে পতিত সরকার প্রধানের নির্দেশে ৫০ একর জায়গায় মেডিকেল কলেজকে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সেই সিদ্ধান্ত আবারও ভেস্তে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানের কৃষি অনুষদের জন্য বরাদ্দ জায়গা থেকে ৫০ একর জায়গা দেওয়ার বিষয়ে একটি আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এটি হলে প্রতিষ্ঠানটির ডিজাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠানের জমি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ কারণে আবারও অনিশ্চিত হয়ে গেলো নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের স্থান নির্ণয়ের বিষয়টি।
জেলার আধুনিক সদর হাসপাতালে তিনটি কোয়ার্টার মেরামত করে চলছে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম। নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ও কিউরেটর মিলে অনুমোদিত পদ ৭৮টি। কর্মরত আছেন ৪৯ জন। অধ্যাপকের ১২টি পদের মধ্যে অধ্যক্ষ ছাড়া বাকি ১১টি পদই শূন্য।
চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘পুরোনো মেডিকেল কলেজে একেকটি বিভাগে যেখানে একাধিক অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক ক্লাস নেন, এখানে তেমন সুযোগ নেই। বিশেষ করে ক্লিনিক্যাল ক্লাসে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, প্রসূতি বিভাগের পাঁচটি পদের মধ্যে শুধু একজন সহকারী অধ্যাপক আছেন। একইভাবে মেডিসিন বিভাগে পাঁচটি পদের মধ্যে দুজন সহযোগী অধ্যাপক এবং সার্জারি বিভাগে দুজন সহযোগী অধ্যাপক কর্মরত। ওই দু-একজন শিক্ষককেই কয়েকটি ব্যাচের তত্ত্বীয়, ব্যবহারিক, আইটেম পরীক্ষাসহ সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। এতে শিক্ষকের ওপর যেমন অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে।
চতুর্থ পর্বে পড়ছেন, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, দেড় বছরের মধ্যে ১০ মাস ক্লাস হয়ে গেছে। আর আট মাস পর তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। অথচ এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ক্লাস তেমন একটা হয়নি।
প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডাক্তার আনোয়ারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, অবকাঠামো স্থাপন, প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে এভাবে মেডিকেল কলেজ চালানো কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে না পারলে চিকিৎসার মতো পেশায় অর্ধশিক্ষিত হয়ে চিকিৎসক তৈরি হবে। এতে আর যাই হোক, মানুষ মানসম্মত চিকিৎসাসেবা পাবে না। আগের পতিত সরকার অর্থ আত্মসাতের জন্য পরিকল্পনাহীন এসব প্রকল্প নিয়েছে।
নেত্রকোনা ১০০ শয্যা আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও রোগী কোনোটাই নেই। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু সাঈদ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসক না থাকায় গুরুতর রোগী থাকে না। এতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ খুব কম থাকছে। ভরসা শুধু বইয়ে পড়া বিদ্যায়।
গত বছরের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০০ একর জায়গা থেকে ৫০ একর জায়গা নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজকে বরাদ্দ দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের বাধায় তা আটকে যায়। এখন পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ কোথায় হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি।
তবে কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুল হাসান বলেন, স্থায়ী জায়গা যেহেতু নির্ধারণ হয়নি, তাই যতটুকু পারছেন অল্প পরিসরের মধ্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো করে নিচ্ছেন। স্থায়ী ক্যাম্পাস হলে অনেক সংকট কেটে যাবে। একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ আছে। এখানে ক্লিনিক্যাল ক্লাসের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় দ্বিতীয় ব্যাচের ৫০ শিক্ষার্থীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
দেশে মোট মেডিকেল কলেজ ১১০টি। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩৭টি। যার মধ্যে নিজস্ব ভবন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়া চলছে ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ। এছাড়া নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই চাঁদপুর মেডিকেল কলেজেরও।
কামাল হোসেন/এফএ/জিকেএস