মক্কার অধিবাসীদের উপেক্ষা, কটুকাটব্য, অত্যাচার সহ্য করে মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম) ১৩ বছর মক্কায় ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু মক্কার বেশিরভাগ মানুষ বিশেষত মক্কার নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বেশিরভাগ ইমান গ্রহণ করেনি। অবশেষে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ আসে। মুসলমানরা ধীরে ধীরে মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাওয়া শুরু করেন।
মক্কার কফেররা যখন বুঝতে পারে মুসলমানরা মদিনায় চলে যাচ্ছে, মহানবিও মদিনায় চলে যাবেন, তখন তারা মহানবিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম) হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। এক রাতে তারা মহানবির বাড়ি ঘিরে রাখে। মহানবি সকালে দরজা খুলে বের হলে তারা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করবে এই ছিল তাদের পরিকল্পনা। মহানবি (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের এই পরিকল্পনার কথা জেনে যান। রাতেই তিনি তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে বের হন এবং সাহাবি আবু বকরকে (রা.) সাথে নিয়ে মদিনার পথে বের হয়ে পড়েন।
সকালে উঠে কাফেররা যখন বুঝতে পারে মহানবি (সা.) ঘরে নেই, মক্কা ত্যাগ করেছেন, তখন তারা হন্য হয়ে মহানবি ও আবু বকরকে খুঁজে বেড়াতে থাকে।
মহানবি (সা.) আবু বকরকে (রা.) নিয়ে সাওর পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নেন। কাফেররা তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ওই গুহার প্রবেশমুখ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারা বলাবলি করতে থাকে পদচিহ্ন তো এখানে এসেই শেষ হয়েছে, তারা এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
কাফেরদের গুহার প্রবেশমুখ পর্যন্ত চলে আসতে দেখে আবু বকর (রা.) খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি ভাবেন এবার আর রক্ষা নেই, ধরা পড়ে যেতে হবে। তিনি মহানবিকে (সা.) বলেন, তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায়, তাহলেই তো আমাদের দেখতে পাবে! কিন্তু মহানবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাাল্লাম) অবিচল ও নিশ্চিন্ত থাকেন। তিনি আবু বকরকে (রা.) বলেন, ‘আবু বকর! সেই দুজনের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী যাদের তৃতীয়জন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।’ (সহিহ বুখারি) অর্থাৎ আমরা এখানে আল্লাহর আশ্রয়ে আছি। তিনি আমাদের রক্ষা করবেনই।
বাস্তাবে হয়েছিলও তাই। কাফেররা একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে থেকেও তাদের দেখতে পায়নি। কোরআনে আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা উল্লেখ করে মহানবির (সা.) প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দুজনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অনন্তর আল্লাহ তার ওপর তার পক্ষ থেকে প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাকে এমন এক সৈন্য বাহিনী দিয়ে সাহায্য করলেন যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের মাথা নিচু করে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তাওবা: ৪০)
মহানবি (সা.) ও আবু বকর (রা.) সাওর পর্বতে তিন দিন লুকিয়ে থাকেন। কাফেররা তাদের খোঁজাখুজি করে ক্লান্ত ও হতোদ্যম হয়ে গেলে তারা বের হয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন।
মদিনার পথে একদিন দুপুর বেলা মহানবি (সা.) ও তার সঙ্গীরা যাত্রাবিরতি করেন খোজাআ গোত্রের অতিথিপরায়ণ নারী উম্মে মা’বাদের তাঁবুর পাশে। মহানবি (সা.) উম্মে মা’বাদকে জিজ্ঞাসা করেন, তার কাছে খাওয়ার মতো কিছু আছে কি না? উম্মে মা’বাদ সাধারণত তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন তার বাড়িতে খাওয়ার মত কিছুই ছিল না। ওই সময়টা ছিল ব্যাপক খাদ্যসংকটের সময়। উম্মে মা’বাদের বকরিগুলো তার স্বামী মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু একটা কৃশকায় দুর্বল বকরি উম্মে মা’বাদের তাঁবুর এক কোণে বাঁধা ছিল যে বকরিটি মাঠে যাওয়ার মত শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল।
উম্মে মা’বাদের কাছে কোনো খাবার নেই শুনে মহানবি (সা.) তার বকরিটি দোহন করার অনুমতি চান। উম্মে মা‘বাদ বলেন, ওর ওলানে দুধ থাকলে তো আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। ওর ওলানে কিছু নেই।
কিন্তু মহানবি (সা.) ওই কৃশকায় দুর্বল বকরিটির বাঁটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখেন ও বরকতের দোয়া করেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরিটির ওলান দুধে পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর তিনি দুধ দোহন করতে থাকেন। প্রথমে মহানবি (সা.) উম্মে মা‘বাদকে দুধ পান করান। তারপর নিজের সঙ্গীদের এবং সবশেষে তিনি নিজে পান করেন। তারপর এক পাত্র দুধ উম্মে মা‘বাদের কাছে রেখে তারা পুনরায় যাত্রা করেন।
উম্মে মা’বাদ পুরো ঘটনা দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হন। তার যে বকরির মাঠে যাওয়ার শক্তিও ছিল না, ওই বকরি এত দুধ দিলো যে কয়েকজন তৃপ্ত হয়ে খাওয়ার পরও দুধ রয়ে গেল! তিনি মহানবিকে (সা.) চিনতেন না। তিনি বুঝতেও পারেননি তার তাঁবুতে কে অতিথি হয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর উম্মে মা’বাদের স্বামী বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে বলেন, আল্লাহর কসম! ইনিই কোরায়শের সেই আলোচিত ব্যক্তি। আমারও ইচ্ছা আছে তার ওপর ইমান আনার, তার অনুসরণ করার, সুযোগ পেলে আমি তার দলভুক্ত হবো।
মহানবি (সা.) সাওর গুহা থেকে বের হয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেছিলেন ১ রবিউল আউয়াল, সোমবার। পরবর্তী সোমবার অর্থাৎ ৮ রবিউল আউয়াল তারা মদিনার নিকটবর্তী এলাকা কুবায় পৌঁছেন। ৪ দিন কুবায় থেকে মহানবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনায় যান। উচ্ছ্বসিত মদিনাবাসী দলবেঁধে তাকে সংবর্ধনা জানায়। কবিতা আবৃত্তি করে, ‘তালাআল বাদরু আলাই না’ অর্থাৎ মদিনায় পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। দিনটি ছিল ১২ রবিউল আউয়াল।
ওএফএফ/জেআইএম