হেমন্ত এসে গেছে গ্রামের উঠানে

16 hours ago 4

তানজিদ শুভ্র

ভোরের প্রথম আলোটা এখনও পুরোপুরি নামেনি। আকাশে ফিকে রোদ। ফসলের মাঠ অনেকটা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, ধানের শীষে শিশির জমে আছে ছোট ছোট মুক্তার মতো। হেমন্ত যেন নিঃশব্দে এসে গেছে গ্রামবাংলার উঠানে। নরম রোদ, না গরম, না শীত—এক মোলায়েম সকাল। ঠিক এই সময়টাই প্রকৃতি আপন খেয়ালে সাজিয়ে নেয় নতুন অধ্যায়।

বাংলায় তখন কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস। গ্রামবাংলা সেজে ওঠে নবান্নের সোনালি রঙে। এই রং-বদলের কথা ভেবেই হয়তো কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে?’

ফসলের মাঠে তখন ধানের গন্ধ। পাকা ধানের শীষ বাতাসে দুলে ওঠে সোনালি ঢেউয়ের মতো। গ্রাম যেন তখন ছবির মতো লাগে। মাঠে চলছে ধান কাটার উৎসব। কাস্তে হাতে কৃষকেরা মাঠের বুক চেঁছে তুলছেন সোনালি স্বপ্ন। কৃষাণিও ব্যস্ত নতুন ফসল ঘরে তুলতে, মাড়াই ঝাড়াই কাজে। নবান্ন উৎসব পালনেও কমতি নেই। নতুন চাল দিয়ে হরেক রকম খাবার।

হেমন্তের রূপবৈচিত্র্য মুগ্ধ করে সবাইকে। প্রকৃতিতে গ্রীষ্ম, বর্ষার মতো হেমন্ত অতটা তীব্র না হলেও এর রূপে-গুণে কমতি নেই। না শীত, না গরমের মাঝেও কখনো আচমকা ঝড়-বৃষ্টির দেখা মেলে। আবার এই হেমন্ত এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে—শীত আসছে। সঙ্গে দেখা মেলে পরিযায়ী পাখি।

খেজুর রসের অধ্যায় শীতকালে মুখ্য হলেও কার্তিক মাসেই দেখা যায় গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করে হাড়ি দিচ্ছে গাছে। নতুন ধানের চাল, খেজুর রসে নবান্নের পিঠাপুলি যেন আলাদা মাত্রা পায়। ধোঁয়া ওঠা চুলোর পাশে মা খেজুর রসের হাঁড়ি বসান। শিশুরা চুলার তাপে হাত ঘঁষে উষ্ণতা খোঁজে।

আরও পড়ুন
চট্টলায় ছাতিম-জড়ানো হেমন্ত সন্ধ্যা
একবার আলমের চা খাইলে, অন্য চা পাইনসা লাগে

বেলা বাড়তে বাড়তে ধীরে ধীরে কমতে থাকে কুয়াশা। নদীর ওপর থেকেও জমে থাকা কুয়াশা কেটে যায়। দেখা যায় নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। ঋতুর রূপ বদল শুধু দূরের গ্রামে নয়, ছুঁয়ে যায় ব্যস্ত শহুরে জীবন। পথের ধারের গাছের পাতা শুকনো রং নিয়েছে। পায়ের নিচে খসখসে শব্দ তোলে। চায়ের দোকানগুলোয় কাপে কাপে ধোঁয়া উড়ছে। মোড়ে মোড়ে ছোট্ট দোকানে ভাপাসহ নানা পিঠা বিক্রি হচ্ছে। যদিও বারোমাসি পিঠা পাওয়া যায় এসব টং দোকানে। তবে শীত আসি আসি অবস্থায় আসে পরিবর্তন।

হেমন্ত থেকে শীতের দূরত্ব খানিক দূরে হলেও শীত শীত অবস্থা দূরত্ব মানে না। সকালের বাতাসে কাঁপুনি লাগে। পাতার ওপর জমে থাকা শিশিরে শীতের আগাম গল্প লেখা থাকে। দিন ছোট হয়। সন্ধ্যা নামে দ্রুত। গোধূলির লাল আভা সরে গেলে কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরে ঘর-বাড়ি, চলার পথ-ঘাট।

হেমন্তে যেমন গৃহস্থ বাড়িতে নবান্ন উৎসব চলে। তেমনই শীত শীত আগমনে একটু উষ্ণ আশ্রয়ের খোঁজ করে গৃহহীন মানুষগুলো। তবু হেমন্ত বিষণ্ন নয়। এ ঋতু শান্ত, নরম। উষ্ণতার মতো একটু স্নেহ মিশ্রিত। এ যেন সেতুবন্ধ—বর্ষার ভেজা স্মৃতি আর শীতের তীব্রতায় যাওয়ার আগে এক কোমল বিরতি।

প্রকৃতি এখন প্রতিদিন শেখাচ্ছে—সবকিছুরই পরিণতি আছে। ধান পাকে, রোদ ফিকে হয়, বাতাস পাল্টায়; মানুষও পাল্টায়। কিন্তু প্রকৃতির এই রূপান্তরেই রয়েছে জীবনের সৌন্দর্য। হেমন্তের ডাক শুনলেই মনে হয়—আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখি। শিশির মুছে যাক, রোদ নামুক পাতার ওপর। তারপর ধীরে ধীরে শীত এসে হাত রাখুক কাঁধে। প্রকৃতির এ যাত্রা যেন থেমে না যায়।

হেমন্তের বৈচিত্র্য উপভোগ করেই হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে–এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়–হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’

লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।

এসইউ/এমএস

Read Entire Article