‘হেলাল ফাঁদে’ ব্যয় বাড়ছে ৫০ কোটি

2 months ago 7

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা কমপ্লেক্স নিকার প্রস্তাবিত জমির পরিবর্তে প্রভাব খাঁটিয়ে নিজের জমিতে নিয়ে যাওয়ায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। পূর্বের প্রস্তাবিত স্থানে নির্মাণের দাবি তাদের।

জানা যায়, প্রাসশনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) প্রস্তাবিত স্থান ছিল মহাসড়কের পাশের সরকারি জমি। তবে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের প্রভাবে তার বাড়ির পাশের তিন ফসলি জমিতে উপজেলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। সেখানে আগে থেকে নাগরিক সুবিধা না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন উপজেলাবাসী। এতে অন্তত ৫০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা। এছাড়া একে বাস্তবতা বিবর্জিত দাবি তুলে সিদ্ধান্ত বাতিল করে নিকার নির্ধারণ করা জমিতে প্রশাসনিক ভবন তৈরির দাবি জানিয়েছেন সচেতন নাগরিকরা।

‘হেলাল ফাঁদে’ ব্যয় বাড়ছে ৫০ কোটি

স্থানীয় সূত্র জানায়, সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিকারের সিদ্ধান্তের তথ্য গোপন করে তার পৈত্রিক নিবাসের পাশে ইসলামাবাদ ইউনিয়নে তিন ফসলি জমিতে উপজেলার প্রশাসনিক ভবন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ জমি মহাসড়ক হতে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। এছাড়া জমির পাশ দিয়ে গেছে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেলপথ। কিন্তু নিকার প্রস্তাবিত জায়গাটি ঈদগাঁও বাসস্টেশনের পূর্বপাশে এক ফসলি ও পরিত্যক্ত জমি। মহাসড়কের পাশের খালি জায়গায় প্রশাসনিক কার্যালয় স্থাপন না করে লোকালয়ের মাঝখানে ইউএনও অফিস হলে নতুন করে সড়ক যোগাযোগও বাড়াতে হবে।

প্রকৌশলিদের মতে, রেললাইনের পাশে বহুতল ভবন সবসময় অনিরাপদ। তাই নিকার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার উদ্যোগী হলে সরকারি অর্থ ও ভোগান্তি দুটিই কমবে।

ঈদগাঁও উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক এহেসান বাবুল বলেন, ২০২১ সালের মাঝামাঝি কক্সবাজার সদরের ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে নতুন ঈদগাঁও উপজেলা ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ‘নিকারে’ উপজেলা সদর দপ্তরের জন্য ঈদগাঁও ইউনিয়নের কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ঈদগাঁও কলেজের পার্শ্ববর্তী খালি স্থানটি নির্ধারণ করা হয়। নতুন দপ্তর স্থাপনের বিধিমালায় বলা আছে, এমন জায়গা নির্ধারণ করতে হবে যেখানে কাছাকাছি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, স্কুল, কলেজ রাস্তা, হাট-বাজার, ব্যাংক, বীমা ও সরকারি হাসপাতাল ইত্যাদি সুবিধা থাকে।

তিনি আরও জানান, কলেজের পাশের প্রথম প্রস্তাবিত জায়গাতে নাগরিক প্রায় সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। এটি পছন্দ করে নিয়মিত অফিস কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিগত ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রস্তাবিত জায়গার প্রতিবেদন চেয়ে স্থানীয় সরকার শাখা কক্সবাজার হতে একটি চিঠিও ইস্যু করা হয়। এ জমিতে প্রশাসনিক ভবন হলে বেশ কিছু খাস জমি অধিগ্রহণে আসবে। ফলে সরকারি টাকার অপচয় সম্ভব।

স্থানীয় সমাজকর্মী আবদুল আহাদ চৌধুরী জানান, প্রথম জমির বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়ার মাসখানেক পর স্থানীয় সরকারের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন তার দুই প্রতিবেশীকে দিয়ে উপজেলার স্থান নির্ধারণ বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে একটি আবেদন করান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর। আবেদনে লেখা হয়, ইসলামাবাদের গর্বিত সন্তান হিসেবে ইসলামাবাদ রেল স্টেশনের পাশে ১০ একর ধানি জমিতে উপজেলার প্রশাসনিক ভবন স্থাপনের ব্যবস্থা করলে আপনার গৌরবের পাশাপাশি এলাকাবাসী উপকৃত হবে ও ইউনিয়নের সন্তান হিসেবে যুগ যুগ আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

তিনি আরও জানান, এ আবেদনের প্রেক্ষিতে পূর্বের ফাইল থেকে ডিজিটাল ট্রেস ও ১৫ সেপ্টেম্বরের চিঠি সরিয়ে ১১ অক্টোবর জেলা প্রশাসককে ইসলামাবাদে স্থান নির্ধারণ করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পত্র দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় রশি টনাটানি। যা মামলা পর্যন্ত গড়ায়। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিন ফসলি জমিতেই ভবন গড়তে সরকারি আদেশ পাশ করানো হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।

প্রকৌশলী জুনাইদ জুয়েল বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সরকারি স্থাপনা গড়তে ফসলি জমি নষ্ট না করার নির্দেশনা আছে। যেখানে উপজেলা দপ্তর করতে সাবেক সচিব ব্যবস্থা করেছেন তা ঈদগাঁও রাবার ড্যামের আওতাধীন তিন-ফসলি জমি। এখানে আগে থেকে কোনো ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নেই। কৃষিজমি নষ্ট করে উপজেলা ভবন করলে রাবার ড্যামের সুবিধা পাওয়া ৮০০ হেক্টর জমি ক্ষতির মুখে পড়ে অকার্যকর হবে। যোগাযোগের জন্য বড় করতে হবে সরু সড়ক। আর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পাশাপাশি ফসলি জমিও গচ্চা যাবে।

তিনি আরও বলেন, নিকারের পছন্দের ঈদগাঁও কলেজের পাশের জমি অধিগ্রহণে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ কম ও খাস জমি থাকায় টাকা পরিশোধ করতে হবে কম। নতুন সড়ক গড়তে হবে না। তাই অধিকতর জনকল্যাণকর নিকারের প্রস্তাবিত জমিতেই ভবন গড়া যুক্তিযুক্ত।

‘হেলাল ফাঁদে’ ব্যয় বাড়ছে ৫০ কোটি

ঈদগাঁও নাগরিক ফোরামের সহসভাপতি সেলিম রেজা বলেন, ঈদগাঁওয়ের প্রশাসনিক ভবন গড়ার জটিলতা নিরসনে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) একটি মতামত দেয়। কউকের নগর পরিকল্পনা বিভাগ হতে ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদগাঁও উপজেলা বিদ্যমান মহাপরিকল্পনা এলাকার বাইরে কিন্তু কউকের অধিক্ষেত্রের আওতাধীন।

পর্যবেক্ষণ মতে, ঈদগাঁও ইউনিয়নের প্রস্তাবিত সাইট চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন। পারিপার্শ্বিক ভূমি ব্যবহারের মধ্যে থানা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম এবং বাণিজ্যিক (শপিংমল, বাজার, ব্যাংক ইত্যাদি) ভূমি ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ্যণীয়। ঈদগাঁও ইউনিয়নের প্রস্তাবিত সাইট ঈদগাঁও স্টেশন হতে প্রায় ৫০০ মিটারে এবং ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ হতে নিকার প্রস্তাবিত জায়গাটি উপজেলার অনেকটা মাঝামাঝি। যা উপকারভোগী ও প্রশাসনের জন্য দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারের বিভিন্ন সেবা প্রদানের উদ্দেশ্য সহায়ক হবে। অন্যদিকে, ইসলামাবাদ ইউনিয়নের প্রস্তাবিত সাইট মহাসড়ক হতে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। ভূমির মাঝে কৃষি ব্যবহারের আধিক্য থাকায় প্রশাসনিক ভবন করতে গেলে শ্রেণি পরিবর্তন আবশ্যক। এতে ইউনিয়নের কৃষি নির্ভর জনগণের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়াও স্থানটি ঈদগাঁও রাবার ড্যামের সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রায় ৮০০ হেক্টর কৃষি জমির আওতাধীন। ফলে ওই স্থানে উপজেলার প্রশাসনিক দপ্তর সমূহ প্রতিষ্ঠা করা হলে রাবার ড্যাম দ্বারা সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত জমির পরিমান হ্রাস পাবে, কমে যাবে রাবার ড্যামের উপযোগিতাও। তাই উপজেলা কমপ্লেক্স স্থাপনে ঈদগাঁও ইউনিয়নের সাইটটি ইসলামাবাদের প্রস্তাবিত সাইটের চেয়ে অধিক উপযুক্ত।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ইসলামাবাদের জমিতেই উপজেলা ভবন গড়তে সরকারি আদেশ জারি হয়েছে। অধিগ্রহণের টাকা দিতে ৮ ধারায় নোটিশ করার পথে আছে।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহারে দেওয়া নির্দেশনা বাতিল করে নিকারের প্রস্তাবিত জমিতে ঈদগাঁও উপজেলা ভবন তৈরি দেশের সম্পদ রক্ষার শামিল হবে। রেললাইনের পার্শবর্তী স্থাপনাগুলো ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়। তাই জেনেশুনে রেললাইনের পাশে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ভবন করার প্রস্তাবনা থামানো শ্রেয়।

সায়ীদ আলমগীর/এমএন/জিকেএস

Read Entire Article