বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) কী হবে? অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যে লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাতে মানুষ সাড়া দেবে? এই কর্মসূচি প্রতিহত করতে সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর (যারা এখনও বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে আছে) ভূমিকা কী হবে? লকডাউনের এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কি তার ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে? অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত একটি দল কি এক বছর বা তার কিছু সময় পরে এভাবে ফিরে আসতে পারে? নাকি এই কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সক্ষমতা ও পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে এবং বড় কোনো কর্মসূচির রিহার্সাল দিতে চায়? জনপরিসরে এরকম নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে তার আগে ১১ নভেম্বর জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর কর্মসূচি এবং এরপরে ১৫ নভেম্বর কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে ‘খতমে নবুয়ত’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের কর্মসূচি নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ যেমন আছে, তেমনি আছে নানা প্রশ্ন।
অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাট অংশই পলাতক। অনেকে কারাগারে। অনেকে বিদেশে। কিন্তু তার মধ্যেই প্রায়শই তাদের নেতাকর্মীদের ঝটিকা মিছিলের খবর পাওয়া যায়। মূলধারার গণমাধ্যমে এই মিছিলের খবর তেমন গুরুত্ব না পেলেও বা গণমাধ্যমগুলো এই মিছিলের খবর গুরুত্ব না দিলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়। তাতে দেখা যায়, মিছিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা খুবই কম এবং মিছিলের সামনে যারা থাকেন, তাদের কেউই সেভাবে পরিচিত মুখ নন। মিছিলকারীদের বডি ল্যাংগুয়েজ বা শরীরী ভাষা দেখে মনে হয়, তারা যত দ্রুত সম্ভব মিছিল শেষ করে কিছু ভিডিও করে স্থান ত্যাগ করতে চান। কিছু মিছিলে অবশ্য লোকসংখ্যা বেশি দেখা যায়। কিন্তু অনেক সময়ই এসব মিছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কোথাও কোথাও বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাধার মুখেও পড়েছে আওয়ামী লীগের এসব ঝটিকা মিছিল।
এই যখন অবস্থা, তখন ১৩ নভেম্বর লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ আসলে কী বার্তা দিতে চাইলো—সেই প্রশ্নটি অনেকের মনে আছে। প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় কবে হবে, তা জানা যাবে ১৩ নভেম্বর। মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল এই তারিখ ঠিক করেন। মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন।
কোনো অজুহাতে কিংবা কোনো কারণেই যাতে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনটি বানচাল হয়ে না যায়। যদি এটা হয় তাহলে তার খেসারত শুধু সব রাজনৈতিক দলকে নয়, দেশের জনগণকেও দিতে হবে। বরং একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য, ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। জুলাই সনদ ও সংস্কারসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে নির্বাচিত সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণই যুক্তিযুক্ত।
১৩ নভেম্বর রায় হবে না। বরং এদিন জানানো হবে যে, রায় কবে দেওয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রতিবাদেই আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিয়েছে। কেননা আওয়ামী লীগ এই ট্রাইব্যুনালকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ মনে করে। দলের পলাতক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে, যেখানে তিনি বলছেন, জনগণ এই ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন প্রতিহত করবে। আসলেই নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের আছে কি না, সেটি অনেক বড় প্রশ্ন এবং এটি শুধু এককভাবে আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে না। বরং দেশে সক্রিয় অন্যান্য দলের শক্তি ও কৌশল এবং বিদেশি শক্তিগুলোর ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।
বৃহস্পতিবারে কর্মসূচির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তিনি লকডাউন কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এটি সত্যিই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি কি না—তা নিশ্চিত নয়। আবার আওয়ামী লীগ এখন যেরকম ছত্রভঙ্গ অবস্থায় রয়েছে, তাতে এ মুহূর্তে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলে আদৌ কিছু আছে কি না, সেটিও প্রশ্ন।
যদিও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনও দলের প্রধান হিসেবে বহাল আছেন এবং ভারত সরকারের আশ্রয়ে থাকা অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছেন। এমনকি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট রিপোর্টাররা সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে সেই সাক্ষাৎকার নেননি। বরং পুরো কাজটি হয়েছে অনলাইনে। তার মানে ভারত সরকার এগুলো অনুমোদন করছে।
অনেকের মনে এরকম প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত ঘোলাটে হতে থাকবে, আওয়ামী লীগের এসব তৎপরতা তত বাড়বে কি না? কেউ কেউ মনে করেন, হয়তো একসময় শেখ হাসিনাকে দেখা যাবে যে তিনি কোনো ভারতীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে অভ্যুত্থানের ১৫ মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এসব তৎপরতাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু সব বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ ছাপিয়ে এখন প্রধানত তিনটি প্রশ্ন জনমনে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। ১. আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে সত্যিই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে কি না এবং তার মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তথা নাগরিকের নিরাপত্তা ব্যাহত হবে কি না। ২. রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেলে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতে জড়ালে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে, অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না। ৩. অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সত্যিই ফিরতে পারবে কি না, বা পারলেও সেটি কোন প্রক্রিয়ায়?
আওয়ামী লীগ ইস্যুতে দেশের বাকি সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে আঁতাত করে কোনো কোন দল নৌকার ভোটগুলো নিজেদের বাক্সে নিতে চাইবে? অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যদি আগামী নির্বাচনে অংশে না পারে তাহলে তাদের ভোটগুলো কারা পাবে, এ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ আছে। রাজনীতির মাঠে এরইমধ্যে এই আলোচনা উঠেছে যে, ৫ আগস্টের পর থেকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সামনে প্রধান ভিলেন হচ্ছে বিএনপি। কেননা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, আগুন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল, চাঁদাবাজি এবং মামলা দিয়ে তাদের জেলে ঢোকানো অথবা পালিয়ে থাকতে বাধ্য করার পেছনে প্রধানত দৃশ্যমান বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এমনকি ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার পেছনেও মূল ভূমিকা পালন করেছে বিএনপির কর্মীরা—এই অভিযোগও আছে। ফলে একসময় জামায়াতকে আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু মনে করা হলেও ৫ আগস্টের পরে মাঠ পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতির কারণে জামায়াত বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই সুযোগটি জামায়াত এবার কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের বাক্সে নিতে চায় এবং তারা এই কাজে অনেকখানি সফল হবে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এই যদি পরিস্থিতি হয়, তাহলে কোনো না কোনো তরিকায় আওয়ামী লীগ ফিরে আসতে চায় কি না বা পারবে কি না, এই আলোচনাটি আছে।
বাস্তবতা হলো, যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দলটি দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে যে ক্ষমতাচ্যুত হলো—তার পেছনে অন্তত বিশটি কারণ আছে। এখানে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা বিদেশি ইন্ধনের অভিযোগ যতই থাকুক, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল—সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু তারপরও অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনীতির আন্তর্জাতিক অংশীদার যেমন ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর অবস্থান কী হবে, তারওপরও আওয়ামী লীগের ফিরে আসা বা রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিক থাকার অনেকখানি নির্ভর করবে। শেখ হাসিনার পতনের পরে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে ভয়াবহ অবনতি হয়েছে এবং তার বিপরীতে ভারতের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে উষ্ণ হয়েছে বা হচ্ছে, ভারত সেটি কীভাবে মোকাবিলা করবে বা কোন কৌশলে এগোবে—তা এখনই বলা মুশকিল।
সুতরাং, আগামী বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচিতে কত লোক সত্যিই সাড়া দেবে; দেশের কতটি স্থানে ঝটিকা মিছিল বা বড় ও মাঝারি আকারের মিছিল হবে এবং তাতে কী পরিমাণ লোক অংশ নেবে; এইসব কর্মসূচি সরকার কীভাবে প্রতিহত বা মোকাবিলা করবে ও করতে পারবে—তার মধ্য দিয়ে হয়তো আগামী দিনের রাজনীতির জল কোনদিকে গড়াবে, তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। আবার রাজনীতিতে যেহেতু শেষ বলে কিছু নেই, অতএব ১৩ তারিখেই সবকিছু বোঝা যাবে, এমনটা নাও হতে পারে।
তবে সরকার ও দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে অন্তত একটি জায়গায় ঐকমত্যে আসতে হবে যে, কোনো অজুহাতে কিংবা কোনো কারণেই যাতে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনটি বানচাল হয়ে না যায়। যদি এটা হয় তাহলে তার খেসারত শুধু সব রাজনৈতিক দলকে নয়, দেশের জনগণকেও দিতে হবে। বরং একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য, ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। জুলাই সনদ ও সংস্কারসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে নির্বাচিত সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণই যুক্তিযুক্ত। আর সেটি যদি সত্যি সত্যি একটি জাতীয় সরকারের অধীনে নয়, আরও ভালো।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/এএসএম

6 hours ago
4









English (US) ·