রেল সংস্কারের অভাবে ১৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত মধ্যপাড়া পাথর খনি রেলপথে পাথর পরিবহনের কাজ। রেল না চলায় সড়কপথে পাথর পরিবহন খরচ বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরের দামে। রেলপথের তুলনায় সড়কপথে খরচ করতে হয় পাঁচগুণ।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই খনির পাথর রেলপথে পরিবহন করার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে পাঁচ গুণ খরচে মধ্যপাড়া খনির উৎপাদিত পাথর পরিবহন করা হচ্ছে সড়ক পথে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) অধীন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খনির ৮০ ভাগ পাথর রেলপথে পরিবহন করতে হবে। কিন্তু ওই নির্দেশনা কাজে আসছে না।
খনি সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন পাথর বিক্রি হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টন। সব মিলিয়ে উত্তোলিত পাথরের অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশই অবিক্রিত রয়েছে।
বতর্মানে নদী শাসনের জন্য ৮৬ কোটি টাকার বোল্ডার ২ লাখ ৭০ হাজার টন পাথর এবং রেলপথের জন্য ২২৭ কোটি টাকার ব্লাস্ট ৬ লাখ ২৪ হাজার টন পাথর ছাড়াও আরও ১১৪ কোটির টাকার পাথর মজুত রয়েছে।
বর্তমানে মধ্যপাড়ায় খনি ১২ ইয়ার্ডে ৪২৭ কোটির টাকার অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ওই রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে রেলপথে পাথর পরিবহন।
কারণ ২০১১ সালে পার্বতীপুরের ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রেলপথের বেশ কয়েকটি জায়গার ৭০টি স্লিপার (পাটাতন) চুরি যায়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ওই পথে পাথরবাহী ওয়াগনের চলাচল। অকেজো হয়ে পড়ে ‘পাথর পরিমাপ স্কেল’।
এ রেলপথে অবকাঠামো ও রেললাইন সংলগ্ন জমি স্থানীয় ভূমিদস্যুরা কব্জায় নিয়েছে। পরিত্যক্ত থাকায় এই রেলভূমির ওপর উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। উজাড় হয়েছে রেলভূমির গাছপালা। চুরি হয় এ রেলপথের প্রায় ৫ কিলোমিটার রেললাইন।
রেলপথ চালুর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, রেলপথে পাথর পরিবহনে ভৈরব-ঢাকা পর্যন্ত প্রতি টনে খরচ হয় মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা। অথচ সমপরিমাণ পাথর সড়কপথে পরিবহনে প্রতিটনে খরচ হয় ১ হাজার ৪শ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা (মধ্যপাড়া-ভৈরব-ঢাকা)।
এতে পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। পাথর পরিবহন খাতে ব্যাপক আর্থিক অপচয় হয়েছে। দেশে পাথরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ টন। এ চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত ও ভুটান থেকে। এতে করে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব।
সেই সঙ্গে দেশের মেগা প্রকল্পসহ অনেক নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় পাথর বিক্রি কমেছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ও নদী শাসন এবং দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় বিশ্বের উন্নতমানের পাথর হিসেবে স্বীকৃত মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ রেলপথে তা পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড খনিটি পরপর চারবার লাভের মুখ দেখেছে। বর্তমানে খনিটিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং প্রায় ১ হাজার দক্ষ খনি শ্রমিক কাজ করছেন। যারা প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টন পাথর উত্তোলন করছেন।
ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া পাথর খনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার বিষয়ে জানতে চাইলে, রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী (পার্বতীপুর/কার্য) প্রকৌশলী মো. রাজা আলী শেখ কালবেলাকে বলেন, পাথর খনিমুখী ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথে স্লিপার, ফিটিংস, পাথর কিছুই নেই। ওই রেলপথে রেললাইন চুরি গেছে। তাই পাথরের কংক্রিট, নতুন রেললাইন স্থাপন ও দুধারে মাটির কাজ করতে হবে।
এ অবস্থায় ওই রেলপথে পাথর পরিবহন অসম্ভব। রেলপথ সংস্কারের পাশাপাশি পাথর পরিবহন উপযোগী (প্রতি সেটে ৪০টি ওয়াগন) ৫ সেট ওয়াগন রয়েছে।
ভবানীপুর রেলস্টেশন-মধ্যপাড়া রেলপথ সংস্কারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) মো. আসাদুর হক বলেন, প্রায় ২৫ কোটি ব্যয়ে ভবানীপুর থেকে মধ্যপাড়া পাথরখনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসে এই রেলপথের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে খনি কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে।
এদিকে, মধ্যপাড়া খনির ১২ ইয়ার্ডে ১১ লাখ ২৪ হাজার টন পাথরের মজুত গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রেলপথে ব্যবহৃত ব্লাস্ট এবং নদী শাসন কাজে ব্যবহৃত বোল্ডার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন। এই দুই সাইজের পাথর বিক্রি কমে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়েছে খনি কর্তৃপক্ষ।
ধারদেনা করে ঠিকাদারের বিল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। দ্রুত এসব পাথর বিক্রিতে গতি বাড়াতে না পারলে স্থানীয়ভাবে কিছু দিনের মধ্যে খনির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে, খনির বিস্ফোরক মেয়াদোত্তীর্ণ কয়েকশ কোটি ক্ষতি হবে। খনিটি বন্ধ হয়ে গেলে জিটিসির অধীনে খনিতে কর্মরত প্রায় ১ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পড়বে।
পাশাপাশি খনি কর্তৃপক্ষের লোকসানের পাল্লা ভারি হবে এবং খনি রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসিকেও মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
অন্যদিকে, ধারদেনা করে খনির ঠিকাদারের বিল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে খনিটি ৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা শোধ করেছে। খনিটি ১৯৭৩-৭৪ সালে আবিষ্কারের পর ২০০৭ সালের ২৫ মে থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দৈনিক তিন শিফটে দিনে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন হচ্ছে। এসব পাথর বিক্রির দায়িত্বে রয়েছে পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড।
পাথর কেনাবেচার অনুমোদিত ডিলার আলহাজ মো. মোমিনুল হক জানান, এই খনির পাথর সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয় না। খনির নির্ধারিত ১৫০ ডিলারদের মাধ্যমে পাথর বিক্রি করা হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরে।
খনিটির একাধিক ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগে ১০ চাকার ট্রাকে (ট্রাকের ওজনসহ) ৪২ থেকে ৪৬ টন এবং ৬ চাকার ট্রাক (ট্রাকের ওজনসহ) ৩০ থেকে ৩২ টন পাথর পরিবহন করা হতো। ২০১৮ সালের মোটরযান এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণবিধি অনুযায়ী ১০ চাকার ট্রাক (ট্রাকের ওজনসহ) ৩২ টন ও ৬ চাকার ট্রাক ২২ টনের বেশি পাথর বহন করতে পারছে না। এতে পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া আগে ৫ শতাংশ কমিশনের স্থলে এখন দেওয়া হচ্ছে ৩ শতাংশ। এর ওপর ভ্যাট কাটা হচ্ছে ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রসেসিং পরিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ আনোয়ার সাদাত কালবেলাকে জানান, সিসি ব্লক তৈরিতে অল্প কিছু মধ্যপাড়ার পাথর খনি থেকে নেওয়া হয়। সিংহভাগই আমদানি করা হয়।