‘সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে মাত্র ২০ জন শ্রমিকের অংশগ্রহণে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা শিল্পে অস্থিরতা আনবে। প্রকৃত শ্রমিকের কণ্ঠস্বর দুর্বল হবে, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হবে।’
জাগো নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ দাবি করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম।
সরকার ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত শিথিল করে ২০ জন শ্রমিকের মাধ্যমে ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ দিয়েছে, আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
বিষয়টা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যদি সরকার সত্যিই চায় যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা নির্বিঘ্নে চলুক, তাহলে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত। কিন্তু যদি তারা মনে করে শিল্প বন্ধ হয়ে গেলেও তাতে কোনো সমস্যা নেই, তাহলে সেটা হবে জাতীয় অর্থনীতির জন্য খুবই নেতিবাচক সংকেত।
আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর এখন বিশ্বের কাছে এক ‘মিরাকল’। এত বাধা, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ খাত এগিয়ে যাচ্ছে, যা অনেকের কাছে হজম করা কঠিন। তাই কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভেতর থেকে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে
কেন আপনি মনে করছেন এই সংশোধনী শিল্পখাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?
কারণ এতে শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। শ্রমিকের সংজ্ঞা নতুনভাবে সংযোজন করে যেভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা আছে। আমি তিন দশক ধরে এই সেক্টরে কাজ করছি, আমার অভিজ্ঞতা বলছে—এটা কোনো সাধারণ ভুল নয়। কিছু মহল সচেতনভাবেই শ্রম অসন্তোষ জিইয়ে রাখার জন্য এ ধরনের পরিবর্তন করছে।
আরও পড়ুন
‘২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতেই ট্রেড ইউনিয়ন’
সময় চেয়ে ৪ মাসেও প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ পাননি বিজিএমইএ সভাপতি
শ্রম আইন সংশোধনসহ পোশাক শ্রমিক সংহতির ১১ দাবি
আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর এখন বিশ্বের কাছে এক ‘মিরাকল’। এত বাধা, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ খাত এগিয়ে যাচ্ছে, যা অনেকের কাছে হজম করা কঠিন। তাই কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভেতর থেকে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
২০ জনে ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রস্তাবটা কোথা কীভাবে এলো?
এটা কিন্তু শ্রমিকদের দাবি নয়। অতীতে আমরা ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়েছিলাম, পরে শ্রমিকপক্ষ বলেছিল ১০ শতাংশ হলেই যথেষ্ট। কিন্তু ২০ জনে ইউনিয়ন করার প্রস্তাব কখনো কেউ দেয়নি। বাস্তবে যাদের শ্রমিকদের মধ্যে কোনো ভিত্তি নেই, তারাই এ ধরনের প্রস্তাব দেয়। কারণ এতে তারা সহজে সংগঠন বানিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত শ্রমিক নেতারা জানেন—২০ জনে ইউনিয়ন হলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। তখন দেখা যাবে, কোনো এলাকার মাস্তান বা ঝুট ব্যবসায়ী নিজের সুবিধার জন্য ইউনিয়ন বানিয়ে ফেলছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই পরিবর্তন নিয়ে কী বলছেন?
তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং যিনি বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একজন—সম্প্রতি দুবার ঢাকা এসেছেন এবং স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি ২০ জনে ইউনিয়ন করার নিয়ম কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশে আর নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। তিনি বুঝতে পারছেন, এতে শ্রম পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠবে এবং উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে।
সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো শিল্পের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু ২০ জনে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান দিলে দুই দিকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আপনারা কি এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছেন?
অবশ্যই। আমরা ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করেছি। প্রায় দুই মাস আগে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন, বিজিএমইএ, মেট্রোপলিটন চেম্বার ও বিশিষ্ট শিল্পপতি তপন চৌধুরীসহ আমরা পাঁচ-ছয়জন মিলে যৌথভাবে চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি আইন উপদেষ্টার সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। বাণিজ্য উপদেষ্টাও নাকি চেষ্টা করেছেন, তবে সফল হয়েছেন কি না জানি না।
শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে শ্রম উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আমার ধারণা, প্রথমে বিষয়টা তার অজান্তেই হয়েছে। যখন আমরা নথিপত্র দেখালাম, তিনি বিস্মিত হন এবং বলেন, এটি তো কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন বিধিমালায় বিষয়টি সংশোধন করবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যদি আইনে এই ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে শুধু বিধিমালা পরিবর্তন করে সমাধান হবে না। আইনে সংশোধন আনতে হবে।
সরকারের ভূমিকা এ প্রেক্ষাপটে কী হওয়া উচিত?
সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো শিল্পের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু ২০ জনে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান দিলে দুই দিকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রকৃত শ্রমিকের কণ্ঠস্বর দুর্বল হবে, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পুরো শিল্পে অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই সরকারকে বিষয়টি নতুন করে বিবেচনা করতে হবে।
সরকারের প্রতি আপনার বার্তা কী?
আমার বার্তা খুব পরিষ্কার—বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আজ যে অবস্থানে এসেছে, তা দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। এই সেক্টরকে নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে না। যদি সরকার শ্রমিকের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, তবে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে বিদেশি বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

2 hours ago
3









English (US) ·