২৪ বল ০ রান ৫ উইকেট ও এজবাস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধ্বংসলীলা

2 months ago 9

ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক ঘটনাই ঘটেছে আজকের এই দিনে। ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ সৌরভ গাঙ্গুলির জন্মদিন থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের ফাসন্ট বোলার ফ্রেড ট্রু ম্যানের কোনো রান না দিয়েই ৫ উইকেট শিকার, কিংবা এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের ধ্বংসলীলা, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করা কেন ফার্নেসের জন্মদিন- অনেক ঘটনার স্বাক্ষী জুলাইয়ের ৮ তারিখ।
জাগোনিউজের পাঠকদের জন্য আজকের এই দিনটির নানা ঘটনা উল্লেখ করা হলো।

১৯৬১: ফ্রেড ট্রুম্যানের অবিশ্বাস্য বোলিং

ইংলিশ ফাস্ট মিডিয়াম ফ্রেড ট্রুম্যান। খেলেছেন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ৬৭টি টেস্ট খেলে উইকেট নিয়েছেন ৩০৭টি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ার আরও দীর্ঘ। ১৯৩৪ সাল থেকে খেলেছেন তিনি। ৬০৩ ম্যাচ খেলে ২৩০৪ উইকেট রয়েছে ট্রুম্যানের নামের পাশে। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বপ্রথম ৩০০ উইকেট শিকারী বোলার হচ্ছেন এই ট্রুম্যান।

পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে, কতটা বিধ্বংসী ছিলেন এই বোলার। ছিলেন তখনকার সময়ে সবচেয়ে গতিসম্পন্ন। যে কারণে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ফায়ারি ফ্রেড নামে।’ তবে, ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বিধ্বংসী কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন তিনি আজকের এই দিনে, ৮ জুলাই। ১৯৬১ সালে লিডসের হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।

৬ জুলাই শুরু হওয়ার পর তিনদিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো টেস্ট ম্যাচটি। ৮ জুলাই, ৩য় বা শেষদিনে বিধ্বংসী একটি স্পেল করলেন ট্রুম্যান। ২৪ বল তথা ৪ ওভারে কোনো রানই দিলেন না। কিন্তু একে একে তুলে নিলেন অস্ট্রেলিয়ানদের ৫টি উইকেট। তার এই বিধ্বংসী বোলিংয়ে ইংল্যান্ড ওই ম্যাচে জয় পায় ৮ উইকেটের ব্যবধানে।

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের তিনি বোকা বানিয়েছিলেন সেদিন গতি কমিয়ে। উচ্চগতির এই বোলার সেদিন গতি কমিয়ে অফকাটার বোলিং করে অসাধারণ সাফল্য পান।

হেডিংলির সেই উইকেটটাও ছিল অদ্ভুত। রঙিন ও রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত পিচ। যেখানে কোনো রান না দিয়ে ২৪ বলে ৫ উইকেট নেয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখান ট্রুম্যান। ওই ইনিংসে শেষ পর্যন্ত ১৫.৫ ওভার বল করে ৩০ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট। পুরো ম্যাচে তার মোট পরিসংখ্যান ছিল ৮৮ রানে ১১ উইকেট।

এই একই মাঠে ফ্রেড ট্রুম্যান আরও একবার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ৭ জুন সফরকারী ভারতীয় দলের প্রথম চারটি উইকেট পড়েছিল শূন্য রানে। অর্থ্যাৎ ভারতের দলীয় স্কোর শূন্য, উইকেটের ঘরে ৪। আর এই চার উইকেটের তিনটিই নিয়েছিলেন ফ্রেড ট্রুম্যান। ওই ম্যাচেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার।

১৯৯৫: এজবাস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধ্বংসলীলা

কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী বোলিং জুটির অন্যতম। সঙ্গে ছিলেন ইয়ান বিশপও। ১৯৯৫ সালের ৬ জুলাই এজবাস্টনের বার্মিংহ্যামে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু হলো সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। রিচি রিচার্ডসন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক এবং ইংলিশ অধিনায়ক ছিলেন মাইক আথারটন।

টেস্টের প্রথম বলটিই যেন বিপদের আভাস দিয়েছিল। কার্টলি অ্যামব্রোসের লেংথ বল মাইক অ্যাথারটনের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বাই হিসেবে হয়ে গেলো চার রান। বাউন্ডারি হলেও, ওই এক ডেলিভারিতেই ইংল্যান্ড বুঝতে পারে, বিপদ আসন্ন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি শেষ হয়ে যায় মাত্র আড়াই দিনে।

পুরো ম্যাচে হলো মাত্র ১৭২.২ ওভারের খেলা। এর মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড পরাজিত হয় এক ইনিংস ও ৬৪ রানে।

ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ১৪৭ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় মাত্র ৮৯ রানে অলআউট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এক ইনিংসে করে ৩০০ রান। বার্মিংহ্যামে ওই ম্যাচের পিচ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। যেটাকে মনে হচ্ছিল যেন ১৯৮০’র দশকের সাবিনা পার্কের পিচের প্রতিচ্ছবি।

ইংলিশ ব্যাটারদের ওপর রীতিমত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ক্যারিবীয় বোলার কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস ও ইয়ান বিশপ। প্রথম ইনিংসে অ্যামব্রোস ও কেনি বেনজামিন নেন ২টি করে এবং ওয়ালশ ও ইয়ান বিশপ নেন ৩টি করে উইকেট।

west indies

দ্বিতীয় ইনিংসে তো অ্যামব্রোসকে বোলিংয়েই আনতে হয়নি। ৩০ ওভারে ৮৯ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। কোর্টনি ওয়ালশ ৫টি এবং ইয়ান বিশপ নেন ৪ উইকেট। একজন ব্যাট করতে নামতে পারেননি। এর মাঝেও ইংল্যান্ডের রবিন স্মিথ অসাধারণভাবে লড়াই করেন। প্রথম ইনিংসে ৪৬ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৪১ রান করেন তিনি।

রবিন স্মিথ ক্যারিবীয়দের আগুনে বোলিং যেভাবে মোকাবেলা করেন তাতে উইজডেন অ্যালমানাক লিখেছে, ‘দ্বিতীয় ইনিংসে করা ৪১ রান সম্ভবত তার শরীর ও বাহুতে পাওয়া ক্ষত-বিক্ষত চিহ্নের সংখ্যার সমান। তবু স্মিথ প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছেন বলে মনে হয়।’

আশ্চর্যজনকভাবে, এর ছয় মাসের মধ্যেই তিনি তার শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন, যা ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এক রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

১৯১১: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মর্মান্তিকভাবে নিহত কেন ফার্নেসের জন্ম

১৯১১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এসেক্সের দ্রুতগতির বোলার কেন ফার্নেস। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ৩০ বছর বয়সে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। লম্বা ও অত্যন্ত দ্রুতগতির বোলার ছিলেন ফার্নেস। যুদ্ধ শুরুর আগে ১৫ টেস্ট খেলে দখল করেন ৬০টি উইকেট।

১৯৩৪ সালে ট্রেন্ট ব্রিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে তিনি অসাধারণ এক রেকর্ড গড়েন ফার্নেস। দুই ইনিংসেই ফাইফার নিয়েছিলেন তিনি। ১৭৯ রান দিয়ে দুই ইনিংসে নেন ১০ উইকেট। অভিষেকের দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট নেয়া বিরল কয়েকজন ক্রিকেটারের একজন তিনি। যদিও ইংল্যান্ড ওই ম্যাচে ২৩৮ রানের বড় ব্যবধানে হেরেছিল।

ফার্নেস কখনো হাল ছাড়তেন না। ১৯৩৬-৩৭ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া ৬০৪ রান তুললেও তিনি একাই লড়াই করে ৬ উইকেট নেন ৯৬ রান দিয়ে। তার এই অসাধারণ ক্রিকেট ক্যারিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধের কারণে থেমে যায়, কিন্তু তার কীর্তি ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

১৯৩২: হার্বার্ট সাটক্লিফের শততম সেঞ্চুরি!

১৯৩২ সালে ব্র্যাডফোর্ডে গ্লুচেস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে ইয়র্কশায়ারের বড় জয়ের ম্যাচে হার্বার্ট সাটক্লিফ তার ক্যারিয়ারের শততম প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরি তুলে নেন। এই ম্যাচে তিনি প্রথম ইনিংসে ৮৩ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন।

সাটক্লিফের এই কীর্তি ইয়র্কশায়ারের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়।

১৯১২: হাম রোগে আক্রান্ত জেরাল্ড ক্রাচলি অপরাজিত ৯৯ রানে

১৯১২ সালে এই দিনে ক্রিকেট ইতিহাসের এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের মধ্যকার ম্যাচে। অক্সফোর্ডের ব্যাটার জেরাল্ড ক্রাচলি ৯৯ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় তার দলের সবকটি উইকেট পড়ে যায়, ফলে তিনি সেঞ্চুরি করার সুযোগ হারান।

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। দিনের খেলা শেষে জানা যায়, ক্রাচলি হাম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ফলস্বরূপ, তিনি ম্যাচের বাকি অংশে আর ব্যাট করতে পারেননি। এই ঘটনা ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বিরল ও বিস্ময়কর মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

সৌরভ গাঙ্গুলির জন্মদিন আজ: ভারতীয় ক্রিকেটের এক কিংবদন্তির গল্প

আজ, ৮ জুলাই ১৯৭২, জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদন্তি সৌরভ গাঙ্গুলি। ক্রিকেটের মাঠে মার্জিত ব্যাটিং ও নেতৃত্বের দক্ষতা তাকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই টেস্টে টানা দুটি সেঞ্চুরি করে তিনি বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের নাম লেখান।

একদিনের ক্রিকেটে তিনি একজন সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।২০০০ সালে, ম্যাচ-ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর ভারতীয় ক্রিকেটের এক কঠিন সময়ে, গাঙ্গুলি ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন।

তিনি ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেন এবং ২০০৩ সালে ভারতকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান। ২০০৪ সালে পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট ও একদিনের সিরিজ জয়ে তার নেতৃত্বে ভারত নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

sourav ganguli

তবে, ২০০৫ সালে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন তার ক্যারিয়ার শেষ, কিন্তু গাঙ্গুলি অসাধারণভাবে ফিরে আসেন। ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেন এবং ২০০৭ সালে এমসিজিতে ১০০তম টেস্ট খেলার মাইলফলক স্পর্শ করেন।

২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের পর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ক্রিকেটের বাইরেও গাঙ্গুলির অবদান অসামান্য। ২০১৯ সালে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এর আগে তিনি বাংলা ক্রিকেটের প্রশাসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আজ তার জন্মদিনে, ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা এই কিংবদন্তিকে স্মরণ করছে তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য।

আইএইচএস/

Read Entire Article