- বই দরকার ৪০ কোটি, ছাপা হয়েছে ৪ কোটিরও কম
- মার্চের আগে শেষ হবে না বই ছাপানোর কাজ
- এবার বছরের প্রথম দিন নতুন বই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা
- ছাপাখানা মালিকদের ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে এনসিটিবি
- তাড়াতাড়ি বই ছেপে দিতে চাপ দিচ্ছে সরকার
বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষও। শিক্ষাপঞ্জি মেনে এবারও ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে। তবে বছরের প্রথম দিনে হাতে পাঠ্যবই পাবে না অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে ‘ঘোর সংকটে’ পড়েছে সরকার। ফলে কবে নাগাদ সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জাগো নিউজকে জানিয়েছে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৪০ কোটি ১৬ লাখ বই ছাপানোর কাজ চলমান। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বইয়ের সংখ্যা ১২ কোটি ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫২টি।
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্থাৎ, মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের সংখ্যা ২৮ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার ৩৩৭টি। তাছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্য দেওয়া হবে প্রায় ৪১ লাখ ‘শিক্ষক সহায়িকা’।
২৫ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত ৪ কোটিরও কিছু কম সংখ্যক পাঠ্যবই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে হিসাবে এখনো ৩৬ কোটির বেশি বই ছাপানো ও বাঁধাই করতে হবে। যা শেষ করে স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছে দিতে আরও অন্তত দুইমাস সময় প্রয়োজন
ছাপাখানার মালিক, মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও এনসিটিবি সূত্র জানায়, বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেল পর্যন্ত ৪ কোটিরও কিছু কম সংখ্যক পাঠ্যবই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে হিসাবে এখনো ৩৬ কোটির বেশি বই ছাপানো ও বাঁধাই করতে হবে। যা শেষ করে স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছে দিতে আরও অন্তত দুইমাস সময় প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
- পাঠ্যবই দ্রুত ছাপানোর তাগিদ শিক্ষা উপদেষ্টার
জানুয়ারিতে সব শ্রেণির নতুন বই দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে
পাঠ্যবই ছাপাতে পাল্টা পদক্ষেপ এনসিটিবির, বেঁধে দিলো সময়সীমা
যদি তা-ই হয়, তবে মার্চের আগে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে পারবে না সরকার। ওইসময়ে অর্থাৎ ২ মার্চ থেকে রমজান, ঈদের দীর্ঘ ছুটি শুরু হবে। ছুটি শেষে স্কুল খুলবে ৮ এপ্রিল। ফলে তার আগে বই নিয়ে পুরোদমে ক্লাসে বসতে পারবে না শিক্ষার্থীরা। ওলটপালট হয়ে যাবে শিক্ষাপঞ্জিও। এতে শিক্ষার্থীরাও নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে পড়বে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণির কয়েকটি লটের বইয়ের পুনরায় টেন্ডার দেওয়া, নতুন টেন্ডার, নোয়া (নোট অব অ্যাওয়ার্ড), ক্রয় কমিটির অনুমোদনসহ আনুষঙ্গিক কাজে দীর্ঘসময় লেগে যাওয়ায় বই ছাপার কাজে ধীরগতি দেখা দেয়। তাছাড়া বছরের শেষ সময়ে এসে কাগজ সংকটের বিষয়টিও সামনে আনছেন ছাপাখানা মালিকরা।
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণির বই ছাপা ঘিরে ‘বড় সংকট’
প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ শেষ দিকে। অনেক উপজেলায় এরই মধ্যে এ তিন শ্রেণির বই পাঠানো হয়ে গেছে। তবে চতুর্থ ও পঞ্চমের বই ছাপার কাজ কিছুটা পিছিয়ে। জানুয়ারির মধ্যে এ দুই শ্রেণির বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন এনসিটিবির কর্মকর্তা ও ছাপাখানা মালিকরা।
সরকার যতই চাপ দিক বা চেষ্টা করুক, মার্চের আগে সব বই দেওয়া সম্ভব নয়। সব বই স্কুলে পৌঁছে দিতে এপ্রিল মাস ছুঁই ছুঁই হবে। এনসিটিবি বাস্তবতা মেনে না নিলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে।- মুদ্রণ সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য
অন্যদিকে মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ঘিরে এনসিটিবির কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বিশেষ কারণে দশম শ্রেণির বই ছাপার কাজ এগিয়ে নিলেও ষষ্ঠ থেকে নবমের বই নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় এনসিটিবি। কয়েকটি শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি এখনো ছাপাখানায় পাঠানো সম্ভব হয়নি। ষষ্ঠ থেকে নবম—এ চার শ্রেণির সব বই পেতে শিক্ষার্থীদের এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
ছাপাখানা মালিকদের ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে এনসিটিবি
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির বর্তমান সভাপতি রাব্বানী জব্বার। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই। নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০২১ সালে নেত্রকোনার খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রাব্বানী জব্বার।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাউসারুজ্জামান রুবেল। তিনি বহুল আলোচিত অগ্রণী প্রেসের মালিক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ কয়েক বছর বই ছাপানোর কাজ একচেটিয়াভাবে বাগিয়ে নেন তিনি। এবারও বেশ কয়েক লট বই ছাপার কাজ নিয়েছেন।
তাছাড়া মুদ্রণ সমিতির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ও সুবিধাভোগী অনেকে রয়েছেন। এনসিটিবি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, তারা দেরিতে কাজ দেওয়ার অজুহাত তুলে বই ছাপানোর কাজে বিলম্ব করছেন। পাশাপাশি বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পাঠ্যবই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজও বাধাগ্রস্ত করছেন।
সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টাকে দেওয়া এক চিঠিতে ‘২৫ মার্চের আগে সব বই ছাপিয়ে দিতে পারবেন না’ বলে সাফ জানিয়ে দেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস-চেয়ারম্যান জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। এর আগে ছাপানোর কাজ শেষ করা সম্ভব নয়।’
আমরা এবার সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা পিছিয়ে কাজ শুরু করেছি। তবে ছাপাখানার মালিকরা আমাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করছেন না। তারা সহযোগিতা করলে সংকট তৈরি হতো না। পাঠ্যবইকে ইস্যু করে কেউ যদি ষড়যন্ত্র করে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।- এনসিটিবি চেয়ারম্যান
মুদ্রণ সমিতির নেতাদের এমন অবস্থান ও ছাপাখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাচ্ছে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপক্ষে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারমান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই নিয়ে ঝামেলা নেই। মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ শেষ করতে কিছুটা দেরি হয়ে যাবে। আমরা চেয়েছি, বছরের প্রথম দিনে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর হাতে অন্তত যেন তিনটি করে বই তুলে দিতে পারি।’
আরও পড়ুন
- পাঠ্যবই পেতেই মার্চ-এপ্রিল, কেমন হবে শিক্ষাপঞ্জি
বইয়ের শেষ পাতায় জাতীয় সংগীত-পতাকা, কারণ জানেন না কেউ!
এনসিটিবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিকসহ সব ছুটি বাতিল
ছাপাখানা মালিকরা পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এবার সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা পিছিয়ে কাজ শুরু করেছি। তবে ছাপাখানার মালিকরা আমাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করছেন না। তারা সহযোগিতা করলে সংকট তৈরি হতো না। পাঠ্যবইকে ইস্যু করে কেউ যদি ষড়যন্ত্র করে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।’
‘স্পর্শকাতর’ ইস্যু, মুখে কুলুপ এঁটেছেন ছাপাখানা মালিকরা
তবে বই ছাপাতে বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সমিতির নেতৃত্বে নেই এমন কয়েকটি ছাপাখানার মালিকও গণমাধ্যমে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তারা বই ‘ছাপার ইস্যু’ ও সময়টাকে ‘খুবই স্পর্শকাতর’ মনে করছেন বলেও জানান।
সমিতির বর্তমান কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিয়মের বাইরে গিয়ে তাড়াতাড়ি বই ছেপে দিতে সরকার আমাদের চাপ দিচ্ছে। তারা যে সময়ে কাজ দিয়েছে, টেন্ডারের নিয়ম অনুযায়ী—এপ্রিলে বই দেওয়ার কথা। তারপরও আমরা কাজ করছি জাতির স্বার্থে। কিন্তু সরকার আমাদের ওপর জবরদস্তি শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার যতই চাপ দিক বা চেষ্টা করুক, মার্চের আগে সব বই দেওয়া সম্ভব নয়। সব বই স্কুলে পৌঁছে দিতে এপ্রিল মাস ছুঁই ছুঁই হবে। এনসিটিবি বাস্তবতা মেনে না নিলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে।’
এএএইচ/এমকেআর/জেআইএম