৫ আগস্টের পর জামাল হোসেনে ‘জিম্মি’ পবিপ্রবি প্রশাসন

2 months ago 9

• শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা
• আত্মীয় পরিচয়ে ফ্যাসিস্ট যুগে পেয়েছেন একের পর এক পদোন্নতি
• দলীয় পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার
• সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ
• নিয়োগ ও টেন্ডারে অনিয়ম

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতি ও প্রযুক্তির ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক স্বপ্নযাত্রার নাম। কখনও যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের নিবিড় সম্পর্ক আর নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার ধ্রুপদী ধারা ছিল, সেখানেই আজ বাতাসে দোলা দিচ্ছে একের পর এক গুঞ্জন, সংশয় আর অস্বস্তির সুর। আলোচনার কেন্দ্রে যে নামটি ঘুরে ফিরে আসছে, তিনি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. জামাল হোসেন। দীর্ঘ অনুসনন্ধানে উঠে এসেছে অধ্যাপক জামাল হোসেনের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, প্রভাব বস্তার করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়াসহ নানান অনিয়মের চিত্র।

সনদের ধূসর গলি

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, অধ্যাপক জামাল হোসেনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। পাওয়া তথ্যমতে, ১৯৮৪ সালে যশোর বোর্ড থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও ১৯৮৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরে ইউক্রেনের ভিএসটিএ নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনার্স (১৯৯৭) ও মাস্টার্স (১৯৯৮) ডিগ্রি অর্জনের দাবি করেন।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) রেকর্ডেও তার সনদের কোনো স্বীকৃতি মেলেনি।

‘সরকার পরিবর্তনের পর যেভাবে তারা পুনর্বাসিত হয়েছেন, তাতে মনে হয়, পবিপ্রবি যেন কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়শিবির।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ.এস.এম এ ফায়েজ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের রেকর্ডে ভিএসটিএ নামে কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান আছে কি না আমার জানা নেই। ইউক্রেনে এ নামে বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে এবং সেখানে পড়াশোনা করলে ভালো, তবে যদি কেউ এই ধরনের অস্বীকৃত ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করে থাকেন, তবে সেটি অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রশ্ন জাগে, ইউজিসির ভেরিফাই না করে কীভাবে তিনি ২০০৩ সালের ২১ মে ৩৭ বছর তিন মাস ১৬ দিন বয়সে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেলেন? কেবল তাই নয়, দ্রুত পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন সহকারী, সহযোগী হয়ে অবশেষে অধ্যাপক!

প্রশ্নবিদ্ধ পদোন্নতি ও ডিন হওয়ার গল্প

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হতে প্রয়োজন আইইএলটিএস স্কোর ও গবেষণাপত্র। অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক জামাল হোসেন এই শর্ত পূরণ করেননি। তবুও গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাবেক চিফ হুইপ আসম ফিরোজ (এমপি), কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন এবং শেখ হাসিনার পিএস ও সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিচয়ে তিনি একের পর এক পদোন্নতি পান।

‘শিক্ষকের আচরণ যদি ভয়ভীতির জন্ম দেয়, তবে সেটা শিক্ষাঙ্গনের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।’

আরও অভিযোগ আছে আইন বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ডিন পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তার মূল একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল কম্পিউটার সায়েন্সে।

দলীয় পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার

অধ্যাপক জামাল হোসেনের বাবা পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আব্দুর রশিদ মিয়া চুন্নু এবং তার ভাই কামাল হোসেন পটুয়াখালী পৌর বিএনপি এবং আরেক ভাই মনির হোসেন কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতা। মূলত তাদের নাম ভাঙিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য, সৃজনী বিদ্যানিকেতনের সভাপতি, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের বিশেষ কর্মকর্তা, বিভিন্ন আসবাবপত্র, যন্ত্রাংস ক্রয়-বিক্রয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ লেকসমুহের মাছ বিক্রি, খামারের ধান, চাল, ডাল, নারিকেল, ডাব বিক্রির কমিটিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো কমিটি নেই যেখানে তিনি নেই।

শিক্ষক সমাজের অনেকে বলছেন, এসব পদ অর্জনের পেছনে রয়েছে দলীয় পরিচয়, তদবির ও প্রশাসনিক প্রভাব। মূলত ৫ আগস্টের পর থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দখলদারিত্ব শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগে যেভাবে তিনি বিরোধিতা করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, গালিগালাজ এবং ব্যাপক হয়রানি করেছেন, তা কোনো শিক্ষকের শোভা পায় না। এতে মনে হয়, তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারেই আগ্রহী।

নিয়োগ ও টেন্ডারে পরিবারের প্রভাব

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভেতরের খবর বলছে, অধ্যাপক জামাল তার স্ত্রীকে প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগে নিয়োগ দিতে দৃশ্যত মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং বারবার বিভাগীয় প্রধান ও প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। শুধু তাই নয়, তার ভাই কামাল হোসেন ও মনির হোসেনের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জামাল হোসেনের বিরুদ্ধে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান কনস্ট্রাকশনের কাজ করা ঠিকাদারদের তিনি বিশেষ কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন সেই ভয়ভীতি দেখিয়ে উৎকোচও গ্রহণ করেন। এমনকি নির্মাণাধীন ১০তলা বিশিষ্ট ছাত্রী হলে একটি কোম্পানির কাছ থেকে উৎকোচের বিনিময়ে দেশের বাজারের অপেক্ষাকৃত মানহীন ‘এক্স মনিকা’ ব্র্যান্ডের টাইলস ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

সহকর্মীদের প্রতি রূঢ়তা ও ক্যাম্পাসে আতঙ্ক

শিক্ষা যেমন আলো জ্বালায়, শিক্ষক তেমনি নির্মাণ করেন সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক জামাল হোসেন সিনিয়র, জুনিয়র সহকর্মীদের প্রতি রূঢ়, হুমকিমূলক ভাষায় কথা বলেন। তার কারণে ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক।

‘অধ্যাপক জামাল হোসেনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা প্রশ্নে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাস করি।’

একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, শিক্ষকের আচরণ যদি ভয়ভীতির জন্ম দেয়, তবে সেটা শিক্ষাঙ্গনের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।

ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক রাজত্ব

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, অধ্যাপক জামাল হোসেন শাবিপ্রবির প্রাক্তন ছাত্রলীগ ক্যাডার মো. মেহেদি হাসান ও পবিপ্রবির সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার শামসুল হক রাসেলকে বহিষ্কারাদেশ উপেক্ষা করে পুনর্বাসন করেছেন।

উল্লেখ্য অধ্যাপক মেহেদি হাসান ২.৯৫ সিজিপিএ থাকা সত্ত্বেও ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগের প্রভাষক, সহকারী, সহযোগী এবং পরে অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ও সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা থাকলেও অধ্যাপক জামাল হোসেনের প্রভাবে তাদের পুনর্বাসিত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি এক সিনিয়র অধ্যাপক বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর যেভাবে তারা পুনর্বাসিত হয়েছেন, তাতে মনে হয়, পবিপ্রবি যেন কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়শিবির।’

এই প্রতিবেদনের বিষয়ে অধ্যাপক মো. জামাল হোসেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পদোন্নতির প্রতিটি ধাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। আমার সনদ ভুয়া হলে তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিত না। আপনারা বললে এবং প্রয়োজন হলে আমি আমার সকল সনদপত্র ইউজিসিতে যাচাইয়ের জন্য দিতে রাজি আছি।

উপাচার্যের প্রতিক্রিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি কয়েক মাস আগে। অধ্যাপক জামাল হোসেনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা প্রশ্নে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাস করি।

এফএ/এএসএম

Read Entire Article