নায়ক হওয়ার স্বপ্ন তাকে সবসময় তাড়া করে ফিরেছে। তাই ব্যবসা কিংবা চাকরি কোনো কিছুতেই স্থির হতে পারেননি। হবেনই বা কী করে! ঢাকাই চলচ্চিত্র যাকে ‘নায়ক রাজ’র আসনে বসানোর অপেক্ষায় রয়েছে তাকে কি আর অন্য কোনো কাজ আটকে রাখতে পারে! বলছি নায়ক রাজ রাজ্জাকের কথা। কোটি দর্শকের ভালোবাসা, নায়কদের রাজার উপাধি পেতে দীর্ঘ বন্ধুর পথ মাড়িয়ে যেতে হয়েছিল অভিনেতাকে।
আজ (২১ আগস্ট) খ্যাতিমান এই নায়কের রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের আজকের দিনে তিনি অসংখ্য অনুরাগীদের কাঁদিয়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমান।
রাজ্জাকের পুরো জীবনটাই সিনেমার গল্পের মতো। নায়ক রাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটাই একটা সিনেমা।’ জীবদ্দশায় অনেকবার সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, একটা সময় ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। দুই সন্তান আর স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে ছিল তার সংসার। তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করতেন। অভিনয় করে সপ্তাহে পেতেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকার মতো। কিন্তু প্রতি মাসের খরচ ছিল ৬০০ টাকা। রাজ্জাক আরও বলেছিলেন, ‘অল্প আয়ে সংসারের খরচ চলে না। বাচ্চাদের দুধ জোগাড় করতেই সব টাকা ব্যয় হয়ে যেত। ওই সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন মাঝেমধ্যে উপোসও করতাম। পয়সার অভাবে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টিভি কেন্দ্রে হেঁটে যাতায়াত করতাম।’
নায়ক রাজ রাজ্জাক ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতমদের একজন হলেও ষাটের দশকে তার শোবিজে যাত্রা হয়েছিল ছোট্ট একটা চরিত্র দিয়ে। সে সময় কেউ ভাবতে পারেননি, কালের পরিক্রমায় একজন ‘এক্সট্রা আর্টিস্ট’ এ দেশের অভিনয়ের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি হয়ে উঠবেন। তার আলোয় যুগ যুগ ধরে আলোকিত হবে বাংলা সিনেমার আঙ্গিনা।
রাজ্জাক ১৯৫৮ সালে কলকাতায় কলেজের ছাত্রাবস্থায় প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান। অজিত ব্যানার্জির ‘রতন লাল বাঙালি’ নামের সেই সিনেমা মূল চরিত্রে অভিনয় করেন আশিস কুমার ও নায়িকা সন্ধ্যা রায়। রাজ্জাক অভিনীত ছোট্ট চরিত্রটি ছিল পকেটমার। তৃতীয় সিনেমা ‘শিলালিপি’। এখানেও তার চরিত্রটি ছিল ছোট। একটি গানের দৃশ্যে তিনি অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন। এতে তিনি ২০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। এ সম্মানী রাজ্জাকের অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নের প্রতি আস্থা আর উৎসাহ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দেয়। তবে তিনি রাজ্জাক বুঝেছিলেন, টালিগঞ্জে (পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রশিল্পের মূল কেন্দ্র) তিনি সুবিধা করতে পারবেন না। ‘এক্সট্রা’ হয়েই থাকতে হবে সারাজীবন। নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করলেন নতুন যাত্রা। তিনি চলে গেলেন মুম্বাই, মানে তখনকার দিনের রঙিন জ্বলমলে শহর বোম্বেতে। সেখানেও খুব একটা সুবিধা হলো না। ভাগ্য তাকে দাঙ্গার কারণে নিয়ে এলো বাংলাদেশে। এখানেই তিনি হয়ে উঠলেন ঢাকাই সিনেমার নায়ক রাজ।
রাজ্জাক কলকাতার নাকতলা এলাকার জমিদার বংশের সন্তান। শৈশব থেকেই একুট অন্যরকম ছিলেন রাজ্জাক। পড়াশোনায় কোনোভাবেই মন বসাতে পারেননি তিনি। স্কুলজীবনে শুরু মঞ্চে অভিনয় করেছেন। ১৯৬২ সালে রাজ্জাক বিয়ে করেন। এর এক বছর পর কলকাতায় দাঙ্গা দেখা দেয়। মর্মান্তিক এ ঘটনা বেদনার হলেও রাজ্জাকের জীবনে এই দাঙ্গা নতুন পথ তৈরি করে দেয়। দাঙ্গার কারণে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা থেকে মুসলমানেরা দলে দলে পাড়ি দেয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ)। রাজ্জাকও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দাঙ্গার সময়ে ঢাকায় চলে আসেন। রাজ্জাক ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসরে জন্য। পরিবার নিয়ে ৮০ টাকা মাসিক ভাড়ায় কমলাপুরের একটি বাসায় ওঠেন।
ঢাকায় আসার পর একদিন সিনমায় অভিনয়ের একটা সুযোগ আসে রাজ্জাকের। ১৯৬৫ সালে ‘আখেরি স্টেশন’ সিনেমায় সহকারী স্টেশনমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ঢাকার সিনেমায় সেটিই রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন।
তবে রাজ্জাকের সিনেমার ভাগ্য ঘুরে যায় আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা জহির রায়হানের হাত ধরে। তার ‘বেহুলা’ সিনেমায় প্রথমবার নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। সেই সিনেমা গ্রাম বাংলা ও শহরে তুমুল সাড়া ফেলে। সুদর্শন রাজ্জাক ও তার মায়াবি হাসি নারী দর্শকের মনে দাগ কাটে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সুচন্দা দিয়ে শুরু এরপর কবরী, শাবানা, ববিতাদের সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক সফল সিনেমা উপহার দেন তিনি।
রাজ্জাক তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘কি যে করি’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘পাগলা রাজা’, ‘বাজিমাত’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মাটির ঘর’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘আনারকলি’, ‘মৌ–চোর’, ‘রাজা সাহেব’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘বদনাম’, ‘লাইলী মজনু’, ‘তালাক’, ‘অভিযান’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘সৎভাই’, ‘শুভদা’, ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘যোগাযোগ’, ‘ঢাকা-৮৬’, ‘বিরহ ব্যথা’,
‘আনোয়ারা’, ‘জুলেখা’, ‘দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘সখিনা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘মনের মত বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘কখগঘঙ’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘রংবাজ’,
‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বাবা কেন চাকর’ প্রভৃতি।
অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে নায়ক রাজ রাজ্জাক একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুস্কারসহ দেশে বিদেশে অনেক সম্মানায় ভূষিত হন।
এমএমএফ/এলআইএ/জেআইএম