অর্থনৈতিক দর্শন যেভাবে বদলে দিতে পারে আপনার দুনিয়া
আমরা সবাই নিজের মতো করে জীবনকে দেখি, বুঝি আর চালাই। এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন, কিসে সুখ পাব — এসব মিলেই তৈরি হয় আমাদের জীবনদর্শন। কারও কাছে জীবন মানে বেশি অর্জন করা, কারও কাছে আবার কম নিয়ে শান্তিতে থাকা। কেউ বিশ্বাস করেন দুনিয়া দেখার জন্য বেশি খরচ করতেই হবে, আবার কেউ মনে করেন—কম খরচেই আনন্দের জীবন সম্ভব। জীবনদর্শনের এই পার্থক্যই ব্যক্তির মানসিকতা, খরচের অভ্যাস, সম্পর্ক, এমনকি সুখ–দুঃখ অনুভব করার ধরন পর্যন্ত বদলে দেয়। এ কারণেই সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো এখন জীবনদর্শনকে মানুষের মানসিক সুস্থতা ও জীবনের গুণগত মানের অন্যতম বড় চালক হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে একটি ধারণা এখন আলোচনা তৈরি করছে — ‘ইকনমিক্যাল লাইফ ফিলোসফি’ বা অর্থৗনতিক জীবনদর্শন। বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এখন গুরুত্ব পাচ্ছে সংযমী বা সচেতন জীবনদর্শন। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার হাতে থাকা সব গ্যাজেট, ফ্যাশন আইটেম বা নতুন জিনিসপত্রের কতটা সত্যিই দরকার? সম্প্রতি অনেকেই বুঝতে পারছেন — অল্প জিনিসের সঙ্গেই জীবনে আসতে পারে বড় সুখ, একটি শান্ত মনের অনুভূতি এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা শান্তি। আজ বিশ্ব দর্শন দিবসে চলুন এই বিষয়টা নিয়ে একটু ভ
আমরা সবাই নিজের মতো করে জীবনকে দেখি, বুঝি আর চালাই। এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন, কিসে সুখ পাব — এসব মিলেই তৈরি হয় আমাদের জীবনদর্শন। কারও কাছে জীবন মানে বেশি অর্জন করা, কারও কাছে আবার কম নিয়ে শান্তিতে থাকা।
কেউ বিশ্বাস করেন দুনিয়া দেখার জন্য বেশি খরচ করতেই হবে, আবার কেউ মনে করেন—কম খরচেই আনন্দের জীবন সম্ভব। জীবনদর্শনের এই পার্থক্যই ব্যক্তির মানসিকতা, খরচের অভ্যাস, সম্পর্ক, এমনকি সুখ–দুঃখ অনুভব করার ধরন পর্যন্ত বদলে দেয়।
এ কারণেই সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো এখন জীবনদর্শনকে মানুষের মানসিক সুস্থতা ও জীবনের গুণগত মানের অন্যতম বড় চালক হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে একটি ধারণা এখন আলোচনা তৈরি করছে — ‘ইকনমিক্যাল লাইফ ফিলোসফি’ বা অর্থৗনতিক জীবনদর্শন। বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এখন গুরুত্ব পাচ্ছে সংযমী বা সচেতন জীবনদর্শন।
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার হাতে থাকা সব গ্যাজেট, ফ্যাশন আইটেম বা নতুন জিনিসপত্রের কতটা সত্যিই দরকার? সম্প্রতি অনেকেই বুঝতে পারছেন — অল্প জিনিসের সঙ্গেই জীবনে আসতে পারে বড় সুখ, একটি শান্ত মনের অনুভূতি এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা শান্তি।
আজ বিশ্ব দর্শন দিবসে চলুন এই বিষয়টা নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক।
১. জীবনসন্তুষ্টি ও মানসিক প্রশান্তি
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে — জীবনে অপ্রয়োজনীয় ভোগ কমিয়ে দিলে মানসিক প্রশান্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা ভোক্তা–মনস্তত্ত্বের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছে।
জার্নাল অব কনজিউমার রিসার্চ-এ প্রকাশিত গবেষণাটি বলছে, ফ্রুগাল বা সংযমী জীবনযাপনকারীরা সাবজেক্টিভ ওয়েলবিইং বা ব্যক্তিগত সুখ–শান্তি বেশি অনুভব করেন। তারা উদ্বেগে কম ভোগেন, মেজাজ থাকে বেশি ইতিবাচক, আর নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণবোধও তুলনামূলক বেশি।
২০২২ সালে পারসোনালিটি অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ডিফারেন্সেস জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা জানায়, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কম রাখলে মানুষের সেন্স অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি বাড়ে। ফলে ছোটখাটো চাপে মন ভেঙে পড়ে না।
অর্থাৎ, কম জিনিস মানেই কম আনন্দ নয় — বরং সাদামাটা জীবনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে গভীর প্রশান্তি।
২. অর্থনৈতিক সচেতনতা ও পরিকল্পিত খরচ মানসিক চাপ কমায়
সংযমী জীবনদর্শনের অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো সচেতন খরচ। হাভার্ড বিজনেস স্কুলের ২০২১ সালের বিশ্লেষণ বলছে, যারা শুধু প্রয়োজন বুঝে ব্যয় করেন ও ইম্পালসিভ বাইং বা হঠাৎ কেনাকাটা কমান, তারা দীর্ঘমেয়াদে অনেক কম স্ট্রেস অনুভব করেন।
এর সঙ্গে মিল রয়েছে আরেক সাম্প্রতিক গবেষণায়। ২০২৫ সালে জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমিক্স রিসার্চ-এ প্রকাশিত মুহাম্মেদ এনেস সায়িন-এর ‘সচেতন ভোগের ওপর মিত্যয়িতা ও বস্তুবাদী মানসিকতার প্রভাব’ গবেষণা প্রমাণ করে যে, ফ্রুগালিটি বা সংযম কনশাস কনজাম্পশন বা সচেতন ভোগ বাড়ায়, যা আর্থিক নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতির অন্যতম ভিত্তি। এতে সঞ্চয় বাড়ে, ঋণের চাপ কমে। ফলে মন থাকে অনেকটা শান্ত।
গবেষকেরা এটিকে বলেন ফাইন্যান্সিয়াল পিস অব মাইন্ড। অর্থাৎ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মানসিক স্থিতির সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
৩. সামাজিক সম্পর্ক ও জীবনের অভিজ্ঞতায় ইতিবাচক পরিবর্তন
সংযমী জীবনদর্শনের প্রভাব শুধু ব্যাংক ব্যালেন্সে নয়, সম্পর্কেও পড়ে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিহেভিয়ারাল সায়েন্স গ্রুপের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন বলে— ভোগ কমালে মানুষ এক্সপেরিয়েন্সিয়াল ওয়েলবিইং বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক সুখে বেশি মনোযোগী হয়।
ফলে তারা পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটায়; নতুন জিনিস কেনার বদলে ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, সৃষ্টিশীল কাজে বেশি আনন্দ খুঁজে পায় এবং স্ট্যাটাস দেখানোর চেয়ে সম্পর্ক গভীর করার দিকে মনযোগ দেয়।
গবেষকের ভাষায়, ‘অভিজ্ঞতার সুখ বস্তুগত আনন্দের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।’
৪. নিজের আত্মপরিচয় ও জীবনের অর্থ খোঁজা
সংযমী জীবনদর্শন শুধু খরচ কমানোর কৌশল নয়, এটি নিজের মূল্যবোধ ও পরিচয় খোঁজার একটি পথ। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি ল্যাবের ২০২০ সালের গবেষণা জানায়, জীবন থেকে অতিরিক্ত জিনিস সরিয়ে দিলে মানুষ তাদের কোর ভ্যালুস বা মূল মূল্যবোধ আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন।
আমার জীবনে সত্যি কী দরকার? - এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। গবেষকেরা এটিকে বলেন ‘মিনিং–ফোকাসড মিনিমালিজম’, যা মানুষকে জীবন, সম্পর্ক ও স্বাধীনতার অর্থ নতুন করে ভাবতে শেখায়।
কেন এখনই শুরু করা যায়?
>> একবার নিজের ব্যয় ও জিনিসপত্র পর্যালোচনা করে দেখুন—কোনগুলো সত্যিই প্রয়োজন, কোনগুলো শুধু অভ্যাস?
>> একটি বাজেট তৈরি করুন। শ্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিন এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন — আমি কেন এইটুকু কিনবো?
>> নিজের সময় ও মনোরঞ্জন কীভাবে কাটাচ্ছেন, সেই দিকে নজর দিন — বন্ধু, পরিবার, প্রকৃতি অথবা নিজের শখে কি আপনি যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন?
>> অন্তত একবার নতুন বস্তুগত জিনিসের বদলে নিজের অভিজ্ঞতার দিকে মন দিন।
অর্থনৈতিক জীবনদর্শন মানে সব বন্ধ করা নয়, বরং একটি সচেতন ও মূল্যভিত্তিক জীবনের দিকে এগোনো। এটি আমাদের শেখায় কী সত্যিই জরুরি এবং জীবনের স্থায়ী সুখ কোথায় লুকিয়ে আছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, দামী জিনিসপত্রের পিছনে না ছুটে আমরা এমন এক জীবন গড়ে তুলতে পারি — যেখানে মন থাকে শান্ত আর সম্পর্ক গুলো হয় গভীর।
সূত্র: জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইকনমিক্স রিসার্চ (২০২৫), ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিনজেন–এর কনজিউমার সাইকোলজি স্টাডি (২০২৩), স্ট্যানফোর্ড বিহেভিয়ারাল সায়েন্স ল্যাব–এর মিনিমালিজম গবেষণা (২০২২)
এএমপি/জেআইএম
What's Your Reaction?