বছরে ১০০ দিনেরও কম ক্লাস, পড়ালেখায় চরম ঘাটতি
এক বছরে ৩৬৫ দিন। অথচ চলতি (২০২৫) শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস হয়েছে ১০০ দিনেরও কম। ছুটি ও পরীক্ষার পর যে কর্মদিবস থাকে, সেই দিনগুলোতেও ঠিকমতো ক্লাস হয়নি। কখনো শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন, কখনো বিক্ষোভ-সমাবেশ। পাশাপাশি পাঠ্যবই হাতে পেতেও দেরি হচ্ছে। ফলে যতটা ক্লাস প্রয়োজন, তা পাচ্ছে না প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনার ব্যাপক ঘাটতি নিয়েই পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে যাচ্ছে তারা। ধারাবাহিক এ শিখন ঘাটতি শিক্ষার মানে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষাবিদ ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিখন বা পড়াশোনার ঘাটতির এ নেতিবাচক ধারা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। তা না হলে অদক্ষ-অযোগ্য ‘শিক্ষিত’ জনশক্তির সারি দীর্ঘ হবে, যা একটি জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। প্রাথমিকে ৩৮ দিন কর্মবিরতি, ১০০ দিনেরও কম ক্লাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী-২০২৫ সালে সরকারি ছুটি ছিল ৭৬ দিন। সপ্তাহে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সেই হিসাবে আরও ১০৪ দিন ছুটি। এতে সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ১৮০ দিন বন্ধ। আরও পড়ুনশিক্ষা উপদেষ্টার ক্লাসে ফেরার আহ্ব
এক বছরে ৩৬৫ দিন। অথচ চলতি (২০২৫) শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস হয়েছে ১০০ দিনেরও কম। ছুটি ও পরীক্ষার পর যে কর্মদিবস থাকে, সেই দিনগুলোতেও ঠিকমতো ক্লাস হয়নি। কখনো শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন, কখনো বিক্ষোভ-সমাবেশ। পাশাপাশি পাঠ্যবই হাতে পেতেও দেরি হচ্ছে।
ফলে যতটা ক্লাস প্রয়োজন, তা পাচ্ছে না প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনার ব্যাপক ঘাটতি নিয়েই পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে যাচ্ছে তারা। ধারাবাহিক এ শিখন ঘাটতি শিক্ষার মানে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষাবিদ ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিখন বা পড়াশোনার ঘাটতির এ নেতিবাচক ধারা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। তা না হলে অদক্ষ-অযোগ্য ‘শিক্ষিত’ জনশক্তির সারি দীর্ঘ হবে, যা একটি জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।
প্রাথমিকে ৩৮ দিন কর্মবিরতি, ১০০ দিনেরও কম ক্লাস
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী-২০২৫ সালে সরকারি ছুটি ছিল ৭৬ দিন। সপ্তাহে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সেই হিসাবে আরও ১০৪ দিন ছুটি। এতে সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ১৮০ দিন বন্ধ।
আরও পড়ুন
শিক্ষা উপদেষ্টার ক্লাসে ফেরার আহ্বানে ‘না’, আমরণ অনশনে শিক্ষকরা
শিক্ষায় বরাদ্দ ‘সামান্য’ বাড়লো
প্রাথমিকে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে
বাকি থাকে ১৮৫ দিন। এর মধ্যে চলতি বছর বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকরা ৩৮ দিন কর্মবিরতি পালন করেন। এর মধ্যে পূর্ণদিবস ১৪ দিন। আর অর্ধদিবস ২৪ দিন। কর্মবিরতির দিনগুলো বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে ১৪৫ দিন। এর মধ্যে পরীক্ষা হয়েছে ২৭ দিন। পরীক্ষার দিনগুলো বাদ দিলে থাকে ১১৮ দিন।
শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির কারণে আরও ১১ দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। এতে ক্লাস হয়েছে এমন দিনের সংখ্যা নেমে আসে ১০৭ দিনে। কিন্তু এ বছর কমপক্ষে একটি করে পাঠ্যবই পেতেও শিক্ষার্থীদের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফলে ক্লাস হয়েছে, এমন দিনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ দিনে; অর্থাৎ ১০০ দিনেরও কম ক্লাস হয়েছে।
ঢাকা, ঝালকাঠি, পাবনার ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, সুনামগঞ্জের অন্তত ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, আন্দোলন, পাঠ্যবই পেতে দেরি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্লাস কম হয়েছে। এমনকি চলমান বার্ষিক পরীক্ষাও বিঘ্নিত হচ্ছে।
ঢাকার বাড্ডার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আরজুমান আরা। তিনি তৃতীয় শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক। ২০২৫ সালে বিদ্যালয়টির হাজিরা খাতায় ঠিক কতদিনের হাজিরার হিসাব রয়েছে, তা জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলে আমার শ্রেণিতে (তৃতীয়) ১৬৪ দিনের হাজিরা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শিক্ষকদের কর্মবিরতির দিনের হাজিরা আছে। বই না পাওয়া সময়েও শিক্ষার্থীদের হাজিরা নিয়ে ছুটি দিয়ে দেওয়া হতো, সেই দিনগুলোও রয়েছে। আর পরীক্ষার দিনেও তো হাজিরা নেওয়া হয়। ফলে ঠিক কতদিন শুধু ক্লাস হয়েছে, তা বলা মুশকিল।’
আরও পড়ুন
দেশে ২০২৪ সালে জলবায়ু সংকটে ৩৩ মিলিয়ন শিশুর শিক্ষা ব্যাহত
আতঙ্ক নিয়েই পাঠদান চলছে ৫৩ বিদ্যালয়ে
ট্রমায় ভুগছে প্রতি ১০০ জনে ৫৫ শিশু, স্কুলে যাচ্ছে না ৩৭ শতাংশ
পাবনা, ঝালকাঠী, রাজশাহী ও ঝিনাইদহের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোথাও ১৬৫ টি, কোথাও ১৬২, কোথাও ১৬৪টি হাজিরার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যালয় খোলা থাকলেই হাজিরা নেওয়া হয়। তবে যে কয়টি হাজিরা, তার সব দিনে যে ক্লাস হয়েছে; তেমনটি নয়। ক্লাসের সংখ্যা হয়তো ১০০টির কমই হবে বলে ধারণা তাদেরও।
সরকারি মাধ্যমিকে বিদ্যালয়েও একই চিত্র
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও ২০২৫ সালে ৭৬ দিন ছুটি ছিল। আর শুক্র-শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল ১০৪ দিন। ছুটিতে মোট বন্ধ ১৮০ দিন। বাকি ১৮৫ দিনের মধ্যে সরকারি স্কুলে পরীক্ষা হয়েছে ৩৬ দিন। পরীক্ষার দিনগুলো বাদ দিলে থাকে ১৪৯ দিন। শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির কারণে আরও ১১ দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
কলেজিয়েট স্কুলে এ বছর সপ্তম শ্রেণির হাজিরা খাতায় ১৬১ দিনের হাজিরা নেওয়ার তথ্য রয়েছে। পরীক্ষা, শিক্ষকদের আন্দোলন, এসএসসির ফল প্রকাশসহ সব দিন হাজিরা নেওয়া হয়। - ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক
তাতে কর্মদিবস কমে দাঁড়ায় ১৩৮ দিনে। এ বছর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরাও আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। এতে অন্তত ৭-১০ দিন ক্লাসের কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। তাছাড়া এসএসসি পরীক্ষা এবং ফল প্রকাশের দিনগুলোতে অঘোষিতভাবে স্কুল বন্ধ রাখা হয়। এতে আরও ১২-১৫ দিন ক্লাস হয়নি। পাশাপাশি মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে দুটি করে পাঠ্যবই হাতে পেয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। ফলে পুরোদমে ক্লাস হয়েছে ৯৫ থেকে ১০০ দিনের মতো।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক জাগো নিউজকে জানান, তাদের স্কুলে এ বছর সপ্তম শ্রেণির হাজিরা খাতায় ১৬১ দিনের হাজিরা নেওয়ার তথ্য রয়েছে। পরীক্ষা, শিক্ষকদের আন্দোলন, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশসহ সব দিন হাজিরা নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে আজও পরীক্ষা বন্ধ
আন্দোলনে ‘নেতৃত্ব দেওয়ায়’ প্রাথমিকের শিক্ষক নেতাকে শোকজ
এবার কমপ্লিট শাটডাউনে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা
প্রকৃতপক্ষে কতদিন ক্লাস হতে পারে-এমন প্রশ্নে ওই শিক্ষক বলেন, ‘৯৫-১০০ দিনের মতো ক্লাস হয়েছে। বাকি দিনগুলোতে হাজিরা হলেও তা পরীক্ষাসহ অন্যান্য কারণে বিদ্যালয় খোলা থাকায় নিতে হয়েছে। যেমন-বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনও হাজিরা নেওয়া হয়। সেদিন তো ক্লাস হয় না। এরকম ক্লাসবিহীন হাজিরার সংখ্যা ৫০ দিনের কম নয়।’
এমপিওভুক্ত স্কুল-মাদরাসায় ‘বেহাল দশা’
সরকারি মাধ্যমিকের মতো বেসরকারি এমপিওভুক্ত, নন-এমপিও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ১৮০ দিন বন্ধ থাকে। তবে মাদরাসায় পূজার ছুটি না থাকায় কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৭৭ দিনে।
এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। এ বছরও অন্তত তিন দফা ঢাকায় এসে অবস্থান কর্মসূচি, কর্মবিরতি করেছেন তারা। এতে প্রকৃতপক্ষে ক্লাস হয়েছে খুবই কম। বছরের শেষদিকে নভেম্বর মাসে এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিছুটা পুষিয়ে দিতে বাড়তি ক্লাস নিয়েছেন।
রংপুর, ঢাকা, সিলেট, কুষ্টিয়া, বগুড়ার অন্তত ১০টি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও ১৪২টি, কোথাও ১৪৬টি হাজিরা নেওয়া হয়েছে। কোথাও আবার ১৩৮টি হাজিরার তথ্যও পাওয়া গেছে। তবে কোথাও ১৫০টির ওপরে হাজিরার তথ্য মেলেনি।
এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমপ্লিট শাটডাউন ছাড়া কর্মবিরতির দিনগুলোতে তারা শিক্ষার্থীদের রোল কল (হাজিরা) করেছেন। এজন্য হাজিরা খাতায় ১৪২, ১৪৬ বা ১৩৮ দিনের হাজিরা দেখা গেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্লাস হয়েছে ৬৫-৭০ দিন।
আরও পড়ুন
এমপিওভুক্ত মাদরাসা শিক্ষকদের বদলি নিয়ে ‘সুখবর’
এমপিওভুক্ত হচ্ছে ১০৮৯ ইবতেদায়ি মাদরাসা, আগামী সপ্তাহে প্রজ্ঞাপন
টানা ২১ দিন প্রেস ক্লাবের সামনে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের অবস্থান
তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ছুটি বাদে যে ১৮৫ দিন অবশিষ্ট থাকে তার মধ্যে কর্মবিরতি করা হয়েছে অন্তত ২৩ দিন। ঢাকায় লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি হয়েছে ১৮ দিন। আর স্কুলে তালা ঝুলানো বা কমপ্লিট শাটডাউন হয়েছে ছয় দিন। এতে সব মিলিয়ে আন্দোলনের কারণে বন্ধ ছিল ৪৭ দিন। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিসহ নানা কারণে আরও ১১ দিন বন্ধ ছিল। এতে বন্ধের দিন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৩-২৪৫ দিনের মতো।
ফলে প্রকৃতপক্ষে ক্লাস হয়েছে, এমন দিনের সংখ্যা ১২০-১২২ দিন। এর মধ্যে বছরে তিনটি পরীক্ষার জন্য সময় লেগেছে ৩৬ দিন। এতে শুধু ক্লাসের দিনের সংখ্যা নেমেছে ৮৪-৮৬ দিন। কমপক্ষে দুটি করে পাঠ্যবই হাতে পেতে আরও তিন সপ্তাহ সময় লেগেছে। তাতে পুরোদমে ক্লাস হয়েছে ৬৫-৭০ দিনের মতো বলে মনে করেন এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
শিক্ষকদের আন্দোলন, ছুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ক্লাস কম হওয়ায় সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, শিক্ষাপঞ্জিতে ছুটি কমানো প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন সমাধান করা জরুরি।
স্কুলে তো ছুটিই বেশি থাকে। তারপর যে কয়দিন ক্লাস হয়, আমি অথবা আমার স্ত্রী মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসি। অধিকাংশ দিনই মেয়ে বলে, বাবা একটু দাঁড়াও, নাম ডাকা শেষ হলে ছুটি। আমাকে আবার নিয়ে যেও। ক্লাস হয় না, পড়াশোনা নেই। - অভিভাবক সিরাজুল ইসলাম
রাজশাহীর বাঘার ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক বিদ্যালয় আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টি ওই এলাকায় বেশ নামকরা। সেজন্য মেয়েকে গত বছর স্কুলটিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। তবে ক্লাস না হওয়ায় সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।
অভিভাবক সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্কুলে তো ছুটিই বেশি থাকে। তারপর যে কয়দিন ক্লাস হয়, আমি অথবা আমার স্ত্রী মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসি। অধিকাংশ দিনই মেয়ে বলে, বাবা একটু দাঁড়াও, নাম ডাকা (হাজিরা বা রোল কল) শেষ হলে ছুটি। আমাকে আবার নিয়ে যেও। ক্লাস হয় না, পড়াশোনা নেই। শুধু প্রাইভেট-টিউশনিতে যেটুকু শিখছে। স্কুলের ক্লাসে ওরা কিছুই শিখছে বলে মনে হয় না।’
আরও পড়ুন
উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা, উদ্বিগ্ন অভিভাবক
‘পরীক্ষাবিহীন’ পড়াশোনায় আস্থা নেই অভিভাবকদের
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রশিক্ষণ পাবেন ৪ লাখ শিক্ষক
শুধু মফস্বলের স্কুল নয়, খোদ রাজধানীর নামি অনেক স্কুলের অভিভাবকদেরও একই অভিযোগ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘এটা এমপিওভুক্ত স্কুল। আমার ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। ওদের সারা বছর ক্লাসই হয় না। এমন হলে বাচ্চারা কী শিখবে?’
দীর্ঘমেয়াদে শিখন ঘাটতি কেন, করণীয় কী
শিক্ষার মান বাড়াতে ক্লাসে পাঠদানের বিকল্প নেই। পাঠদান করান শিক্ষকরা। তারাই ক্লাসের বাইরে মনোযোগী। অথবা দাবি আদায়ের আন্দোলনে ব্যস্ত।
শিক্ষকদের দাবি, তাদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকার বলছে, শিক্ষকরা যা চাইছেন তা যৌক্তিক। কিন্তু তাদের দাবি পূরণে সরকারের বা রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা নেই।
দিন যতই গড়াচ্ছে ক্লাসে পাঠদানের মান কমছে, শিক্ষার্থীরাও কম শিখছে। হাতে পাঠ্যবই যাচ্ছে দেরিতে, শিক্ষক ক্লাসে আসছে না, একের পর এক ছুটি-এমন নানান সংকট। শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি নিয়ে যখন আমরা কাজ করি; যেসব তথ্য-উপাত্ত সামনে আসে; তা দেখলে গা শিউরে ওঠে। অথচ সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-দপ্তর দেখেও না দেখার ভান করে। - সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী প্রধান রাশেদা কে চৌধুরী
শিক্ষক ও সরকারের এমন ‘চাহিদা-যোগানের’ অসামঞ্জস্যতায় পাঠদান ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী প্রধান রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেন, দিন যতই গড়াচ্ছে ক্লাসে পাঠদানের মান কমছে, শিক্ষার্থীরাও কম শিখছে। হাতে পাঠ্যবই যাচ্ছে দেরিতে, শিক্ষক ক্লাসে আসছে না, একের পর এক ছুটি-এমন নানান সংকট। শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি নিয়ে যখন আমরা কাজ করি; যেসব তথ্য-উপাত্ত সামনে আসে; তা দেখলে গা শিউরে ওঠে। অথচ সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-দপ্তর দেখেও না দেখার ভান করে। তারা দায়সারা কাজ করে নিজের মেয়াদকাল পার করে সরে পড়ে। এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না। এর খেসারত দিতেই হবে।
আড়াই-তিনমাস ক্লাস হলে তা খুবই কম হবে। বছরের অন্তত ছয়টি মাস (১৬০-১৮০ দিন) পুরোদমে পাঠদান চলা উচিত। সেটা শুধু মুখস্থ করানো পাঠদান নয়। ফলপ্রসূ শিক্ষা দিতে হবে। ক্লাসে পাঠগুলো এমনভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, যা শিশুরা বাসায় গিয়ে তা নিজেই পড়তে পারে। - ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আড়াই-তিনমাস ক্লাস হলে তা খুবই কম হবে। বছরের অন্তত ছয়টি মাস (১৬০-১৮০ দিন) পুরোদমে পাঠদান চলা উচিত। সেটা শুধু মুখস্থ করানো পাঠদান নয়। ফলপ্রসূ শিক্ষা দিতে হবে। ক্লাসে পাঠগুলো এমনভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, যা শিশুরা বাসায় গিয়ে তা নিজেই পড়তে পারে। এজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দরকার। গাইড বই, বাড়তি বই বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যবইটা বছরের শুরুতে হাতে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর শিক্ষকদের ক্লাসমুখী করতে হবে। এর বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন
শিক্ষার মানকে দুর্বল রেখে কোনো দেশে অগ্রগতি হয়নি
‘ভালো-খারাপের বিশ্বাস ভেঙে দিতেই নতুন শিক্ষাক্রম’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থামছে না বুলিং, ‘শিকেয় তোলা’ নীতিমালা
কর্মজীবনে শিখন ঘাটতির নেতিবাচক প্রভাবের ‘শঙ্কা
বছরের পর বছর শিখন ঘাটতি নিয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। দেশের স্কুল-কলেজে যেমন শিখন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান।
তিনি জনপ্রশাসন, ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। তার মতে, দীর্ঘমেয়াদি শিখন ঘাটতি নিয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর বা তার চেয়েও উচ্চতর ডিগ্রি নিলেও তা কাজে আসে না। এ ধরনের গ্র্যাজুয়েটরা অনেকক্ষেত্রে কর্মজীবনে নানা সংকটে পড়েন। তারা নিজের কর্মক্ষেত্রে সফল হতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন।
বিভিন্ন গবেষণা ও আমার অভিজ্ঞতা বলে-যারা শিক্ষাজীবনে শিখন ঘাটতি নিয়ে বেড়ে ওঠে; তাদের কর্মক্ষেত্রে সফল হতে নানা চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। কেউ কেউ চাকরিটা পেয়ে যান, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত সার্ভিস দিতে পারেন না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো রুগণ হয়ে পড়ে। - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান
অধ্যাপক সাদিক হাসান বলেন, ‘প্রাথমিকে ইংরেজি-গণিত ঠিকমতো না পারা শিশুটি মাধ্যমিকেও তা কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার ঘাটতি থেকেই যায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে ধরনের তাতে অনেকে মাধ্যমিক পেরিয়েও যায়। কলেজে যায়; বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়; কিন্তু তার ঘাটতিটা থেকে যায়। খুব কম শিক্ষার্থী তা রিকভার করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন গবেষণা ও আমার অভিজ্ঞতা বলে-যারা শিক্ষাজীবনে শিখন ঘাটতি নিয়ে বেড়ে ওঠে; তাদের কর্মক্ষেত্রে সফল হতে নানান চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। কেউ কেউ চাকরিটা পেয়ে যান, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত সার্ভিস দিতে পারেন না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো রুগণ হয়ে পড়ে। এভাবে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান যখন এমন সংকটে পড়ে, তখন কিন্তু তা রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষ জনশক্তি পেতে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা জরুরি।’
এএএইচ/এমআরএম/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম
What's Your Reaction?