অনিয়মিত অভিবাসীদের হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্যের
অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত নিতে রাজি না হওয়া দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভিসা নীতি সীমিত বা বাতিল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ।
যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে গত সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি সংক্রান্ত ‘ফাইভ আইস’ গ্রুপের বৈঠকে তিনি এমন কথা বলেছেন৷ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রধান এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ক্যানাডার মন্ত্রীরা। মূলত এই পাঁচটি দেশের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘ফাইভ আইস’৷
এমন একসময় ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই মন্তব্য করেছেন, যখন ছোট নৌকায় ফরাসি উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। এমন প্রেক্ষাপটে অভিবাসন ইস্যুতে বিরোধী দলগুলোর তীব্র চাপের মুখে রয়েছে সরকার এবং বাড়ছে জনরোষও৷
ইভেট কুপারকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ পেলেন বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা শাবানা মাহমুদ। শুক্রবার ঘোষণা আসার পর শনিবার থেকে নতুন দপ্তরে কাজ শুরু করেন তিনি। সেদিনই রেকর্ড সংখ্যক এক হাজার ৯৭ জন অভিবাসী চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন।
সোমবার বৈঠকে অংশ নিয়ে শাবানা মাহমুদ বলেন, যুক্তরাজ্যের সীমান্ত ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করাই তার ‘প্রধান অগ্রাধিকার’৷
ভিসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যেসব দেশের নাগরিকেরা অনিয়মিতভাবে আমাদের দেশে অবস্থান করছেন এবং যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে চায় না—এই বিষয়টি সুরাহা করার ক্ষেত্রে আমরা মনে করি পারস্পরিক সহযোগিতার আকর্ষণীয় ক্ষেত্র রয়েছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যাদের আমাদের দেশে থাকার অধিকার নেই, তাদের যেন আমরা আমাদের দেশ থেকে ফেরত পাঠাতে পারি এবং তারা যেন তাদের নিজ দেশে ফিরে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশ বল খেলায় রাজি হবে না (যে দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে সম্মত নয়), তাদের ক্ষেত্রে আমরা “ফাইভ আইস” দেশগুলো সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে পারি৷’
শাবানা মাহমুদ বলেন, ‘এর অর্থ হলো ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ভিসার সুযোগ কমিয়ে আনা। কারণ, আমরা আশা করি, দেশগুলো যদি বল খেলতে চায়, তাদের নিয়ম মেনে খেলতে হবে৷ যদি আপনার কোনো নাগরিকের আমাদের দেশে থাকার অধিকার না থাকে, তাহলে আপনাকে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে৷’
ভবিষ্যতে কোন দেশগুলোকে ভিসা স্থগিতাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, তা অবশ্য নির্দিষ্ট করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার অবশ্য আগেই বলেছেন, তিনি ভিসার ক্ষেত্রে ‘অনেক বেশি লেনদেনমূলক’ পদ্ধতির পক্ষে।
গত জুনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অনিয়মিত অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে কোনো দেশ যুক্তরাজ্যকে কতটা সহযোগিতা করবে, তার ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভিসা ইস্যু করার বিষয়টি তিনি বিবেচনায় রেখেছেন।
অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলায় নতুন কৌশলে ‘ফাইভ আইস’
সোমবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলায় ‘ফাইভ আইস’ জোটের মধ্যে সহযোগিতামূলক একটি চুক্তি হয়েছে। আর এই চুক্তি ‘আমাদের অস্ত্রভাণ্ডারে আরেকটি হাতিয়ার’ হিসেবে কাজ করবে।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং যাদের এখানে থাকার অধিকার নেই, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আমরা আমাদের সব ধরনের কৌশল প্রয়োগে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷’
ব্রিটিশ হোম অফিস বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর ছোট নৌকায় চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছানো অভিবাসীর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে৷ এই সংখ্যা ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলেও মন্তব্য করেছেন শাবানা মাহমুদ৷
বার্তা সংস্থা পিএ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চলতি বছর ছোট নৌকায় যুক্তরাজ্যে আসা অভিবাসীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেড়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরির পরিচালক ড. ম্যাডেলিন সাম্পশন বলেন, ‘অনেক দেশেই প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর হার কম, কিন্তু সেসব দেশের নাগরিকদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ভিসার চাহিদা অনেক বেশি৷’
উদাহরণ হিসেবে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশগুলো ভিসা সীমিত করার হুমকির প্রতিক্রিয়া কীভাবে জানাবে, তা নির্ভর করছে তাদের নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়ার গুরুত্ব কতটা তারওপর৷’
তিনি মনে করেন, ‘এই প্রতিক্রিয়া দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে ভারতসহ কিছু দেশের দীর্ঘদিন ধরে ভিসা সুবিধা আদায়ের ইতিহাস রয়েছে।’
তবুও নাখোশ বিরোধী দল
ভিসা সীমিত করার এই ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস ফিলপ।
তিনি বলেন, ‘এই লেবার সরকার শুধু কঠোর কথা বলছে, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখন সময় এসেছে, তারা যেন সত্যিকার অর্থেই কঠোর পদক্ষেপ নেয়।’
তিনি আরও বলেন, যেসব দেশ তাদের নাগরিকদের ফেরত নিচ্ছে না, তাদের জন্য যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা বন্ধ করা উচিত।
ক্রিস ফিলপ বলেন, ‘লেবার পার্টির সরকার আমাদের সীমান্ত রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে খুবই দুর্বল এবং আমি এর পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখছি না।’
আশ্রয়প্রার্থীদের রাখা হবে সামরিক ঘাঁটিতে
আবাসন সংকট সামাল দিতে বিভিন্ন হোটেলে রাখা আশ্রয়প্রার্থীদের সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে আসার চিন্তা করছে যুক্তরাজ্যের সরকার৷ অভিবাসীদের আগমন বেড়ে যাওয়া এবং আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলে রাখার প্রতিবাদে দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করেছেন স্থানীয়রা। এর জের ধরে সরকার নতুন এই পরিকল্পনা নিয়েছে।
শাবানা মাহমুদ খুব তাড়াড়াতি এই পরিকল্পনাটি প্রকাশ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি বলেছেন, সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের রাখার জন্য সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের কথা ভাবছে। কারণ, হোটেল থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
জন হিলি আরও বলেছেন, সরকারের কর্মকর্তারা অন্যান্য ‘বেসামরিক’ আবাসনের বিষয়টিও বিবেচনা করছে।
বর্তমানে ৩২ হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী হোটেলে আছেন। ফলে করদাতাদের অর্থের অপচয় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে।
বর্তমানে এসেক্সের পরিত্যক্ত সামরিক ঘাঁটি আরএএফ এবং কেন্টের পরিত্যক্ত সামরিক ঘাঁটি নেপিয়ার ব্যারাকে আশ্রয়প্রার্থীদের রাখা হচ্ছে। এ দুটি কেন্দ্র অবশ্য চালু করেছে সাবেক রক্ষণশীল সরকার।
রোববার প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের সম্ভাব্য অস্থায়ী আবাসনের জন্য আরও ‘সামরিক এবং বেসামরিক’ স্থান খুঁজছে সরকার।