অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন

7 hours ago 7

ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের অন্ধকার রাত। শীতল হাওয়ার সঙ্গে ফুটপাতের ধুলা মিশে যেন এক ধরনের নীরবতা তৈরি করেছে। সেই নীরবতার মাঝেই একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুকের হাতে পৌঁছালো এক প্লেট পোলাও-রোস্টে। ভেজা চোখে বললেন, 'আজ অনেকদিন পর এমন খাবার পেলাম। ভেবেছিলাম, আর জীবনে খাওয়া হবে না।'

এটি শুধু একটি গল্প না। এটি আমার-আপনার মানবিকতার দরজায় করাঘাত। একবার কি ভেবে দেখেছেন যে, প্রতিদিন আমরা কত সহজেই না খাবার অপচয় করি! অনেকেই হয়তো ভাবেন না এই বিষয়ে। তবে কিছু মানুষ ভাবেন। তারাই সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর সামনে তুলে দেন এক প্লেট গরম খাবার। আজ (১৬ অক্টোবর) বিশ্ব খাদ্য দিবসে জানবো তাদেরই কথা।

রাজধানীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান - বিয়ে, জন্মদিন বা কর্পোরেট ইভেন্টে - অযথাই অতিরিক্ত খাবার তৈরি করা হয়, যেন কম না পড়ে। নামিদামি ভেন্যুগুলো এই অতিরিক্ত খাবার ফেলে দেয়, কারণ তাদের প্রতিদিন টাটকা খাবার পরিবেশন করতে হবে। আবার অনেকে সংরক্ষণ করার কাজ এড়াতে এই খাবার নষ্ট করে ফেলে।

অথচ সে খাবারের কিছু অংশও যদি নিরাপদভাবে বিতরণ করা যায়, তাহলে অনেক মানুষের ক্ষুধা মেটানো সম্ভব। পারি ফাউন্ডেশন এবং প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের মতো কিছু সামাজিক সংগঠন সেই কাজেই নিয়োজিত। তারা শুধু খাবার বিতরণ করেন না, মানুষকে সচেতনও করেন।
পারি ফাউন্ডেশন

খাদ্য অপচয় রোধে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পারি ফাউন্ডেশন। বিয়ে, জন্মদিন কিংবা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার অসহায়ের হাতে তুলে দিচ্ছে সংগঠনটি।

‘খাবার অপচয় মানে শুধু নষ্ট নয়, এটি মানবতার ক্ষতি।’ ছবি/পারি ফাউন্ডেশন
‘খাবার অপচয় মানে শুধু নষ্ট নয়, এটি মানবতার ক্ষতি।’ ছবি/পারি ফাউন্ডেশন

পারি ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবু তালেব বলেন, 'আপনি যখন একটি প্লেট খাবার নষ্ট করছেন, তখন অন্য কারও আহার কেড়ে নিচ্ছেন। খাবার অপচয় মানে শুধু নষ্ট নয়, এটি মানবতার ক্ষতি।' তিনি বলেন, অধিকাংশ অনুষ্ঠান শেষ হয় রাতে। তখন যদি অনুষ্ঠান থেকে ফোন আসে যে - এতো জনের খাবার বেঁচে গেছে - তখন আমরা তা সংগ্রহ করি।

‘খাবার অপচয় মানে শুধু নষ্ট নয়, এটি মানবতার ক্ষতি।’ ছবি/পারি ফাউন্ডেশন
`অপচয় রোধ করা আমাদের কাজের অংশ।‘ ছবি/পারি ফাউন্ডেশন

‘রাত বারোটা বা একটার পরেও ফোন এলে স্বেচ্ছাসেবীরা প্রস্তুত থাকে। অপচয় রোধে কখনো কখনো রাতে এক হাজার থেকে ১২০০ খাবার‌ বিতরণ করেছি। কারণ অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি, অপচয় রোধ করাও আমাদের কাজের অংশ।'

প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন
এক‌ই ধরনের কাজে নিজেদের অবদান রেখে চলেছে প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন। প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের ফাউন্ডার ইকরাম উদ্দিন আবির বলেন, 'বিশ্ব খাদ্য দিবস আসলে আনন্দের নয়। এটি দুঃখের দিন। কারণ জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্য পূরণে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা খাদ্য উৎপাদন করি, কিন্তু তা সঠিকভাবে বিতরণ করতে ব্যর্থ।‘

`প্রতিদিন ঢাকার হোটেল ও বুফেতে খাবার নষ্ট হয়, অথচ শহরের বিভিন্ন কোণে মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। যদি এই খাবার সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়, অন্তত কিছুটা ক্ষুধা দূর করা সম্ভব’, বলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন
‘আমরা খাদ্য উৎপাদন করি, কিন্তু তা সঠিকভাবে বিতরণ করতে ব্যর্থ।‘ ছবি/প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন

বিশ্বের চিত্রও আমাদেরকে সতর্ক করে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এর তথ্যমতে, প্রতি রাতে ৮১১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমায়। ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, প্রতি বছর নষ্ট হওয়া খাবারের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে বিশ্বের ৮৭৭ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব।

অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন
একজন বাংলাদেশি বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাবার নষ্ট করে। ছবি/প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন

ইউএন‌ইপি ২০২৪ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৪.১ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়। অর্থাৎ একজন বাংলাদেশি বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাবার নষ্ট করে।

এফ‌এও এর তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আয়ের পরিবারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাবার অপচয় হয়। সরকারের হিসাব মতে, জনপ্রতি দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪০৫ গ্রাম। সে হিসাবে গৃহস্থালির অপচয় রোধ করা গেলে বছরে প্রায় ৯.৪ মিলিয়ন মানুষের চালের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন
প্রতিদিন ঢাকার হোটেল ও বুফেতে খাবার নষ্ট হয়, অথচ শহরের বিভিন্ন কোণে মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। ছবি/প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন

অপচয়ের প্রভাব পরিবেশের উপরেও পড়ে। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য বনভূমি কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কারণে নদী, খাল-বিল ও ফসলের ক্ষেত বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। প্রতি বছর ৩৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়ায়।

পারি ফাউন্ডেশন ও প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের মতো অন্যান্য সংগঠনগুলো এই সমস্যা মোকাবিলায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তারা শুধু খাবার বিতরণ করছে না, সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্ণধাররা বলেন, 'খাবারের অপচয় রোধ করলে আমরা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। তাই এক প্লেট খাবারের মূল্য বোঝা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অপচয় কমালে ক্ষুধামুক্ত হবে সমাজ।'

অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার কী করেন
এক প্লেট খাবারের মূল্য বোঝা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ছবি/পারি ফাউন্ডেশন

খাবারের অপচয় রোধ মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাদ্য পৌঁছানো। কমলাপুরের বৃদ্ধ ভিক্ষুকের চোখের আনন্দ অনুভব করলেই বোঝা যায়, এক প্লেট খাবার কত জীবন বদলাতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত অতিরিক্ত খাবার তৈরি না করা, অবশিষ্ট খাবার বিনিময় করা এবং সচেতন হওয়া। খাদ্য অপচয় রোধ কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি মানবতার প্রতিফলন।

তথ্যসূত্র: ইউএন‌ইপি, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, এফ‌এও

এএমপি/জিকেএস

Read Entire Article