এস ইসলাম, লন্ডন থেকে
লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে উগ্র ডানপন্থি টমি রবিনসনের নেতৃত্বে ‘ইউনাইট দ্য কিংডম’ ব্যানারে আয়োজিত এক সমাবেশে লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী এতে প্রায় এক লাখ দশ হাজারের মতো লোক সমাগম হয়।
কে এই টমি রবিনসন?
টমি রবিনসনের প্রকৃত নাম স্টিফেন ক্রিস্টোফার ইয়াক্সলে-লেনন। তিনি একজন অতি ডানপন্থি ও অভিবাসনবিরোধী সক্রিয় ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা, বিশেষত: ইসলামবিরোধী মতাবলম্বীদের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ইংলিশ ডিফেন্স লীগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন নেতা। তার বিরুদ্ধে বিচারিক সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন, বহুবিধ আইনগত বিতর্ক ও বর্ণবৈষম্যবিষয়ক অভিযোগ রয়েছে। তিনি এ সমাবেশের একজন মুখ্য সমন্বয়ক।
আজকের সমাবেশটি ছিল মূলত: অভিবাসনবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী চেতনাকেন্দ্রিক। আয়োজকরা এটিকে ‘মুক্ত মতপ্রকাশের উৎসব’ হিসেবে উল্লেখ করলেও র্যালির প্রধান দাবিগুলো ছিল অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো, সীমান্ত ও আশ্রয়নীতি কঠোর করা এবং ব্রিটিশ জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা।
সকাল থেকেই ইউনিয়ন জ্যাক ও সেন্ট জর্জ পতাকা হাতে বিপুল জনতা সেন্ট্রাল লন্ডনের দিকে আসতে থাকেন এবং দুপুরের দিকে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ পেরিয়ে মিছিল শুরু হয়। অনেকে রবিনসনের সমর্থনে পোস্টার বহন করে এবং তার লেখা বই বিক্রি হচ্ছিল। অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই দাবি করেন, এটি কোনো ডানপন্থি সমাবেশ নয়, বরং ‘দেশপ্রেমিক সফর’।
হোয়াইটহল দ্রুত উপচেপড়া ভিড়ে রাস্তাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে হাজার হাজার মানুষ ব্রিজ ও পার্লামেন্ট স্কয়ারে আটকে পড়ে।
সমাবেশ দুটি পাশাপাশি হওয়ায় এলাকায় বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘উল্লেখযোগ্য আক্রমণাত্মক আচরণ’ লক্ষ্য করা গেছে এবং বিভিন্ন অপরাধে মেট্রোপলিটন পুলিশ নয়জনকে গ্রেফতার করে। উত্তেজিত জনতা কিছু পুলিশ কর্মকর্তার দিকে বিভিন্ন বস্তুও নিক্ষেপ করে।
দুইপক্ষকে আলাদা রাখতে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয় বেশ কয়েকটি রাস্তা বন্ধ করে বেরিকেট দেওয়া হয়। মেট পুলিশ জানিয়েছে, তারা ওই দিনের জন্য পার্শ্ববর্তী লেইসেস্টারশায়ার, নটিংহ্যামশায়ার, ডেভন ও কর্নওয়াল থেকে পাঁচ শতাধিক পুলিশ ও পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ভ্যানও এনেছে। অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা সরঞ্জামসহ পুলিশ এবং ঘোড়সওয়ার পুলিশও মোতায়েন করা হয়। বিকেল ৩টার পর হোয়াইটহলে পুলিশ সারি দিয়ে দুইপক্ষকে আলাদা করে রাখা হয়।
মেট পুলিশ জানিয়েছে, দুইপক্ষকে আলাদা রাখতে গিয়ে কিছু কর্মকর্তা হামলার শিকার হয়েছেন। পুলিশ সামাজিক মাধ্যমে জানায়, ইউনাইট দ্য কিংডম দলের অনেক বিক্ষোভকারী স্টেরাইল এলাকা ভেঙে বা পুলিশ কর্ডন অতিক্রম করে প্রতিপক্ষের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এ সমাবেশে টিভি উপস্থাপক কেটি হপকিনসও বক্তব্য দিয়েছেন। যিনি এর পূর্বে রবিনসন, লরেন্স ফক্স ও অ্যান্ট মিডলটনের সঙ্গে শোভাযাত্রার সামনের সারিতে ছিলেন। সমাবেশে ইলন মাস্ক এক ভিডিও বার্তা দিয়ে ‘সরকার পরিবর্তনের’ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমাদের হাতে চার বছর অপেক্ষা করার মতো সময় নেই, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা অনেক লম্বা সময়ের ব্যাপার। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে এবং নতুন ভোট নিতে হবে।
বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটের দিকে ট্রাফালগার স্কয়ারের কাছে রবিনসন সমর্থকদের পেছনে ঠেলে দিতে গিয়ে কিছু কর্মকর্তাকে লাঠিচার্জ করতে দেখা গেছে। পুলিশের দিকে কাঁচের বোতল, লোহার রড ও বিয়ারের ক্যানের মতো বস্তুও ছোঁড়া হয়েছে।
অন্যদিকে, দুপুর দেড়টার দিকে স্ট্যান্ড আপ রেসিজমের বিশাল মিছিলটি পাল মাল রোড ধরে সামনে অগ্রসর হয়। এটি ট্র্যাফালগার স্কয়ারের কাছাকাছি পৌঁছালেই শুরু হয় ভারি বৃষ্টি। প্রায় বিশ মিনিটের মতো ভারী বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মিছিলটি হোয়াইট হলের দিকে এগোতে থাকে। তাদের হাতে ছিল ‘শরণার্থীদের স্বাগত, ডানপন্থা বন্ধ করো’ ইত্যাদি স্লোগান সংবলিত হরেক রকমের পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড।
স্ট্যান্ড আপ টু রেসিজম সমাবেশে স্বতন্ত্র এমপি ডায়ান অ্যাবট বলেন, তিনি অংশগ্রহণকারীদের সহমত পোষণ করতে এসেছেন। আমরা জানি বর্ণবাদ, সহিংসতা ও ফ্যাসিবাদ নতুন কিছু নয়। কিন্তু আপনারা জেনে থাকবেন যে, আমরা সব সময় এই বর্ণবাদ ও সহিংসতাকে পরাজিত করেছি।
মিছিলের আগেই মেট পুলিশ জানিয়েছিল, তারা ইউনাইট দ্য কিংডম শোভাযাত্রায় মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি বা লাইভ ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রয়োগ করবেন না।
তারা আরও জানিয়েছে, লন্ডনের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রবিনসনের বিক্ষোভকে ঘিরে ‘বিশেষ উদ্বেগ’ রয়েছে, কারণ অতীতে তার সমাবেশে মুসলিমবিরোধী মন্তব্য ও আপত্তিকর স্লোগানের রেকর্ড রয়েছে।
দুইপক্ষকে আলাদা রাখতে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য এবং পাঁচ শতাধিক অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভকারীরা কাঁচের বোতল, লোহার দণ্ড ও বিয়ার ক্যান পুলিশদের দিকে নিক্ষেপ করে। নয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। পুলিশ ঘোড়সওয়ার ও দাঙ্গা দমন বাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কমান্ডার ক্লেয়ার হেইন্স লন্ডনের মুসলিমদের তাদের নিজেদের পরিকল্পনা পরিবর্তন না করতে এবং কেন্দ্রীয় লন্ডন এড়িয়ে না চলতে পরামর্শ দেন। অধিকন্তু, জনসমক্ষে থাকাকালীন কোনো প্রকার উদ্বেগের বিষয় লক্ষ করলে সরাসরি পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, যদি কোনো আচরণ বৈষম্যমূলক হয় বা প্রতিবাদের সীমা অতিক্রম করে ঘৃণাজনিত অপরাধে পরিণত হয়, পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেবে। পুলিশ ‘ভয় বা পক্ষপাত ছাড়াই’ দায়িত্ব পালন করবে।
মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, তারা মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেনি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও পুলিশ ‘ভয় বা পক্ষপাত ছাড়াই’ দায়িত্ব পালনের আশ্বাস দিয়েছে। দুই পক্ষের বিক্ষোভ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে — ইউনাইট দ্য কিংডম সমাবেশ সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে এবং পাল্টা বিক্ষোভ বিকেল ৪টার মধ্যে।
পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গত এক সপ্তাহ লন্ডন মূলত: স্থবির ছিল। আজকের এই দিনে পুরো সেন্ট্রাল লন্ডন জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আন্দোলনের চাওয়া-পাওয়া, বা লাভ-ক্ষতির হিসেবের বাইরেও সমাবেশে আগতদের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে। আশপাশের খাবার বা পানীয় দোকানগুলিতে ছিল উপচেপড়া ভিড়।
ওয়েস্টমিনিস্টার আন্ডারগ্রাউন্ড আগে থেকেই বন্ধ ছিল। আশপাশের এমবেঙ্গকমেন্ট, টেম্পল ও চেরিংক্রস স্টেশনগুলোও ছিল লোকে লোকারণ্য। সমাবেশ দুটি প্রায় চার/পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে থাকলেও একটি হতে আরেকটিতে যেতে রাস্তা বন্ধের কারণে প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো লেগেছে।
আজকের র্যালিটি প্রমাণ করলো যে অভিবাস বিষয়টি এখন আর কেবল রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়, বরং জনজীবনের কেন্দ্রীয় প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি একদিকে যেমন নাগরিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে সরকারের জন্যও এক কঠিন সতর্কবার্তা।
যদিও বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী শান্তি ছিল, এছাড়া কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও পুলিশের সঙ্গে বিবাদ আন্দোলনকে কলঙ্কিত করেছে। পাশাপাশি ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের ওপরও সর্মথন লক্ষ্যণীয় ছিল।
এমআরএম/জিকেএস